বেনজীরের সহযোগী তৈমুরের সম্পদের খোঁজে দুদক
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে আগেই তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছিল দুদক।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ যে বিপুল সম্পদ কিনেছেন তার সহযোগিতায় ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা তৈমুর ইসলাম। এই তৈমুর নিজেও নানা অপরাধে জড়িয়ে পুলিশের চাকরি খুইয়েছিলেন। কিন্তু নানা কৌশলে পরে চাকরিতে ফেরেন। তৈমুরও অঢেল সম্পদের মালিক বলে তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে সংস্থাটির একটি দল। অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে আগেই তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছিল দুদক।
সে মামলা বর্তমানে তদন্ত করছে সংস্থাটি। তবে সম্প্রতি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে জমি কেনার নেপথ্যে তৈমুরের নাম আসায় দুদকের তদন্তে গতি পেয়েছে। গতকাল দুদকের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র বলছে, তৈমুরের বিরুদ্ধে চলমান মামলার তদন্তের পাশাপাশি তার আর কোথায় কোথায় সম্পদ রয়েছে সে বিষয়ে খোঁজ নিতে কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে গাজীপুর, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে কোথায় কোথায় তৈমুর ইসলামের জমি আছে সেসব খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছে দুদক। এ ছাড়া ব্যাংকে লেনদেনের তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হবে বলেও জানিয়েছে দুদকের সূত্র।
দুদকের একজন কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ পরিদর্শক তৈমুর ইসলামের বিষয়টি গত কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর তার পুরোনো মামলার তদন্তে গতি পেয়েছে। সে সঙ্গে এই কর্মকর্তার যাবতীয় সম্পদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছে দুদক।
গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও গাজীপুরসহ যেসব স্থানে বেনজীর আহমেদের জমি কেনার কাজ তৈমুর ইসলাম করেছেন সেখানে তার নিজের সম্পদের খোঁজও পেয়েছে সংস্থাটি। তবে কী পরিমাণ রয়েছে তা এখনো চূড়ান্তভাবে জানতে পারেনি দুদক। এ ছাড়া ঢাকায় কয়টি প্লট, ফ্ল্যাট রয়েছে সেসব বিষয়েও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে। দুদকের আরেক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, তৈমুর ইসলাম ও তার পরিবারের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়ার জন্য চিঠি পাঠানো হবে শিগগিরই। পুরনো মামলার তদন্তের অংশ হিসেবেই এসব খোঁজখবর নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে জমি কেনার কাজ করা পুলিশ পরিদর্শক তৈমুর ইসলাম ১৯৯৫ সালে উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। রাজধানীর ধানমণ্ডি থানায় কর্মরত থাকাকালীন ২০০২ সালের জুনে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরে তিনি বিভাগীয় মামলায় জিতে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে পুনরায় ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) যোগ দেন। ২০১৩ সালের জুনে তিনি পরিদর্শক হন। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে তৈমুর ইসলামকে সাতক্ষীরা থানায় বদলি করা হয়।
সূত্র আরও জানায়, বেনজীরের পক্ষে জমি কেনার কাজ করার সময় তৈমুর খুলনায় দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে নিয়মিত গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে গিয়ে জমি কেনার কাজ করতেন। পরে ২০২১ সালে তাকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্ব দেয়া হয়।
তৈমুরের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে অঢেল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আসে দুদকে। সে বছরই সংস্থাটি অনুসন্ধান শুরু করে। দুদকের তৎকালীন উপ-সহকারী পরিচালক (বর্তমানে সহকারী পরিচালক) জি এম আহসানুল কবীর অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে খুলনা জেলা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে তৈমুরের বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান শুরু করেন উপ-পরিচালক মোহা. আবুল হোসেন। যথা সময়ে অনুসন্ধান শেষ না হওয়ায় কমিশন আবারো কর্মকর্তা বদল করে দায়িত্ব দেয় উপ-পরিচালক শাওন মিয়াকে। ২০১৮ সালে দায়িত্ব পাওয়ার পর শাওন মিয়া তিন বছরের মতো সময় ব্যয় করে তৈমুরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করেন।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে চাকরি থেকে বরখাস্ত অবস্থায় অ্যাপার্টমেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নামের একটি কোম্পানিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তৈমুর ইসলাম। ওই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারই ছোট বোনের স্বামী আজিজুর রহমান। পরে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি থেকে ২০১০ সালে অব্যাহতি নিয়ে পুলিশে যোগ দেন।
খুলনা শহরে চারতলা বাড়ি: দুদকের সে সময়ের অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, পুলিশ কর্মকর্তা তৈমুর ইসলাম খুলনা শহরের টুটপাড়া এলাকায় ৩৭ শতক জমি কেনেন। এই জমির ওপর চারতলা ভবন নির্মাণ করেন। এর মধ্যে ১৩ শতক জমি ও একটি ফ্ল্যাট তার বাবা এস এম এ মজিদের নামে লিখে দেন।
অনুসন্ধানে আরও বলা হয়, মূলত অবৈধ অর্থ গোপন করার উদ্দেশ্যেই তৈমুর ইসলাম নিজের বাবাকে দান হিসেবে দুদকের সমপদ বিবরণীতে উল্লেখ করেন। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা অনুসন্ধানকালে পুলিশের এই কর্মকর্তার মোট ১.৭৩৫ একর জমির তথ্য পান। যার দলিল মূল্য ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। ওই জমিতেও ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন বলে দাবি করেন তৈমুর। অর্থাৎ অবকাঠামোসহ তার মোট ৪৯ লাখ ৭০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়। এ ছাড়া খুলনার ডুমুরিয়ার বড়ডাঙ্গায় ৬২ শতক জমিতে ১টি দোতলা ভবন তৈরি করেন তৈমুর। এই ভবনের ব্যয় হিসেবে তৈমুর সম্পদ বিবরণীতে ১২ লাখ টাকা ব্যয় দেখালেও আয়কর নথিতে ২০ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, পুলিশের এই কর্মকর্তার নামে প্রায় অর্ধকোটি টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ পায় দুদক। এর মধ্যে সাড়ে ৩২ লাখ টাকা মূল্যের একটি টয়োটা এলিয়ন গাড়িও রয়েছে। যা তৈমুরের ঢাকায় থাকা পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করেন। ২০১১ থেকে ২০১৭ এই ছয় বছরে মাসিক ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হিসাবে অন্তত ২১ লাখ টাকা গাড়ির পেছনে ব্যয় হয়েছে। যা তিনি আয়কর নথিতে দেখাননি। ওই টাকা তৈমুরের অবৈধ বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ হয়।
এ ছাড়া পুলিশের এই কর্মকর্তার দুইবার বিদেশ ভ্রমণের তথ্যও পাওয়া যায় অনুসন্ধানে। এসব ভ্রমণে তিনি মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে ৫ লাখ ১০ হাজার ৪৪৬ টাকা ব্যয় করেন। এ অর্থ তিনি দেশে এসে সুদসহ পরিশোধ করেন। এই খরচের হিসাব বা আয়ের উৎস তিনি দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী বা আয়কর নথিতে দেখাননি। একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে বিদেশে গমন করে এই বিপুল অঙ্কের ব্যয় অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
এসব অনুসন্ধান শেষে ২০২১ সালের ১৮ই মার্চ অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা শাওন মিয়া বাদী হয়ে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭(২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং আইন ৪(২) ধারায় পুলিশ কর্মকর্তা তৈমুরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে দুদকের খুলনা সমন্বিত কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক তরুণ কান্তি দাস মামলাটি তদন্ত করছেন।
এ বিষয়ে খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ মানবজমিনকে বলেন, মামলাটি তদন্ত করছেন কর্মকর্তা। তদন্তকালে তৈমুর ইসলামের আরও কোনো সম্পদ পাওয়া গেলে তা অভিযোগপত্রে যুক্ত করা হবে।
দুদকের মামলা ও নতুন করে অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে তৈমুর ইসলামকে ৭ বার তার মুঠোফোনে কল করা হয়। কিন্তু তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। অবশ্য হোয়াটসঅ্যাপে তার নম্বরটি সচল রয়েছে। সেখানে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তা ছাড়া তৈমুরকে হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠিয়ে কথা বলতে চাইলেও তার উত্তরও দেননি তিনি।