বিদেশি ঋণের সুদ: ৯ মাসে পরিশোধ ১০৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার
ইআরডি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বাংলাদেশ শুধুমাত্র সুদ বাবদ উন্নয়ন সহযোগীদের পরিশোধ করেছে ১০৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: ডলার সংকটের মধ্যেই বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি ডলার ছাড়ালো। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ খরচ হয়েছে ১০৫ কোটি ডলার, যা জাতীয় বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দের ৯৪ শতাংশ। দেশীয় মুদ্রায় যার (প্রতি এক ডলার সমান ১১০ টাকা ধরে) পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা দ্বিগুণের বেশি। গত অর্থবছরে একই সময়ে সুদ বাবদ ৪৮ কোটি ডলার পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। প্রকাশিত দেশের বৈদেশিক ঋণের হালনাগাদ পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তৈরি করা সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
ইআরডি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বাংলাদেশ শুধুমাত্র সুদ বাবদ উন্নয়ন সহযোগীদের পরিশোধ করেছে ১০৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। এ হিসেবে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১১৭ শতাংশ। গত ৯ মাসে সব মিলিয়ে ২৫৭ কোটি ডলারের বেশি সুদ ও আসল পরিশোধ করা হয়েছে। গত বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৭৩ কোটি ডলার।
ইআরডি’র প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে আসল ও সুদ মিলিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়ে ৩৫৬ কোটি ডলার হতে পরে। ইআরডি’র কর্মকর্তারা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সুদহার বেড়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) বেড়েছে। বর্তমানে সোফর সুদহার ৫ শতাংশের বেশি, যা এই যুদ্ধের আগে ১ শতাংশের কম ছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের বাজার-ভিত্তিক ঋণ ক্রমাগত বাড়ছে। এই কারণে বাংলাদেশকে এখন সুদ বাবদ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে যে ঋণ পায় তার প্রায় ৭৫ শতাংশ বাজার-ভিত্তিক ঋণ। এ ছাড়া এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে বাজার-ভিত্তিক সুদে ঋণ নেয়। বিশ্বব্যাংক থেকেও স্বল্প পরিসরে বাজার-ভিত্তিক ঋণ নেয় বাংলাদেশ। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ডলার সংকটের এ সময়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে রিজার্ভ ও বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীন ও রাশিয়ার স্বল্প মেয়াদের ঋণের কারণে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। ইতিমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। মেট্রোরেল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের কিস্তিও শুরু হয়েছে। এ ছাড়া কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধও শিগগিরই শুরু হবে। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে অন্য মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হলে চাপ আরও বাড়বে। অন্যদিকে ঋণের ছাড় আগের তুলনায় খুব একটা বাড়েনি। ইআরডি সূত্র বলছে, জুলাই-মার্চ সময়ে সব মিলিয়ে ৫৬৩ কোটি ডলার এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫৩৬ কোটি ডলার।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, আমাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তবে সস্তা ঋণের পরিমাণ কমছে। বাজার ভিত্তিক ঋণ ও দ্বিপক্ষীয় ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। এসব ঋণের সুদহার বেশি, আবার পরিশোধের সময়ও কম থাকে। আবার আমাদের অনেক মেগা প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণের গ্রেস প্রিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় আসল পরিশোধের চাপও বেড়েছে, এবং আগামীতে এই চাপ আরও বাড়তে থাকবে। এ অবস্থায় আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ পরিশোধে সতর্ক থাকতে হবে। যদিও আমরা এখনো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইনি, এরপরেও ভালো প্রকল্প বাছাই করার পাশাপাশি রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বাড়তে হবে।
এদিকে ইআরডি’র তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ৭.২৪ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। ইআরডি’র কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে ১০.১৯৪ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে।
ইআরডি’র তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে এডিবি’র কাছ থেকে। এই সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া গেছে ২.৬২ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি। এ ছাড়া জাপানের কাছ থেকে ২.০৩ বিলিয়ন ডলার এবং বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ১.৪১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বৈদেশিক অর্থ ছাড় হয়েছে ৫.৬৩ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে অর্থ ছাড়ের পরিমাণ ছিল ৫.৩৬ বিলিয়ন ডলার। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি অর্থ ছাড় করেছে এডিবি। সংস্থাটি অর্থ ছাড় করেছে ১.৪০ বিলিয়ন ডলার। জাপান ছাড় করেছে ১.৩৫৮ বিলিয়ন ডলার, বিশ্বব্যাংক করেছে ৯৬৭ মিলিয়ন ডলার, রাশিয়া ৮০৭.৫০ মিলিয়ন ডলার এবং চীন ৩৬১.৭১ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে।
ইআরডি সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে টাকার অঙ্কে সব মিলিয়ে ১১ হাজার ৬০১ কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জন্য বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ৯ মাসেই খরচ হয়ে গেছে এ খাতে বরাদ্দ ৯৪ শতাংশ অর্থ।
অবশ্য ঋণদাতা সংস্থা ও দেশকে স্থানীয় মুদ্রা টাকায় ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করা হয় না। মার্কিন ডলার কিংবা অন্য বিদেশি মুদ্রায় এই অর্থ পরিশোধ করা হয়। কিন্তু বাজেটে হিসাব রাখার সুবিধার জন্য সুদ বাবদ স্থানীয় মুদ্রায় বরাদ্দ রাখা হয়। তবে বাজেট ঋণের মূল পরিশোধের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ রাখা হয় না। ডলারের বাড়তি দামের কারণে টাকার অঙ্কেও ঋণ পরিশোধ অনেক বেড়ে গেছে।