বাজেটের সঙ্গে অর্থনৈতিক বাস্তবতার মিল নেই: সিপিডি
গতকাল ‘সিপিডি বাজেট ডায়ালগ-২০২৩’ শীর্ষক সেমিনারে এসব জানায় সংস্থাটি।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট চলমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও সংকট সমাধানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলে মনে করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জনও দুঃসাধ্য। ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর নজর না দিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপের প্রেক্ষিতে জনগণকে সুরক্ষা দেয়া এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার ওপর জোর দেয়ার তাগিদ দিয়েছে সিপিডি। গতকাল ‘সিপিডি বাজেট ডায়ালগ-২০২৩’ শীর্ষক সেমিনারে এসব জানায় সংস্থাটি।
সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। বক্তব্য রাখেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি উপদেষ্টা প্রফেসর ড. এম শামসুল আলম, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এর সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সমীর সাত্তার, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আক্তার লিমা প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট মূল সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে বলে মনে হচ্ছে। ফলস্বরূপ বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে উল্লেখযোগ্য ব্যবধান রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেট সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে অত্যধিক মুদ্রাস্ফীতি। চলমান সংকট মোকাবিলায় বাজেট ব্যবস্থায় প্রতিফলন হয়নি। প্রস্তাবিত বাজেট চলমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও সংকট সমাধানে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
সিপিডি জানায়, সামষ্টিক অর্থনীতিতে নানা ধরনের চাপ আছে। প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে অর্থনৈতিক বাস্তবতার মিল নেই। বাজেটে চলমান সংকটের স্বীকৃতি ও সমাধানের উদ্যোগ অপ্রতুল। এনজিও ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কোম্পানি হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে কর আরোপের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে সিপিডি। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচনী বছরে কোনো ভাবেই এমন বাজেট হতে পারে না। এটা অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তবায়নযোগ্য। এটা অবশ্যই সংশোধন করতে হবে।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, বড় বাজেট দিয়ে সরকার খুশি হলেও আমরা আতঙ্কগ্রস্ত। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত অভিঘাতে আছে। এই খাতে এক ধরনের লুণ্ঠনমুখী ব্যবস্থা রয়েছে। ডিসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার সামির সাত্তার বলেন, রক্ষণশীল বিনিয়োগের বছর চলছে। এই সময়ে শ্রমিকের মজুরির চাহিদা পূরণের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা করলে মুদ্রাস্ফীতির বাজারে কিছুটা সাহায্য করবে বলে মনে করি।
সেমিনারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নন-প্রফিট এনজিওগুলোকে কোম্পানি আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শহরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর দিতে পারলেও কীভাবে একটি গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করপোরেট কর দেবে? এটা কেমন শিক্ষাবান্ধব বাজেট হলো?
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, বাজেট পাসের আগে আয়কর আইন পাস করা হচ্ছে। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। আইনের সঙ্গে অর্থবিলের সম্পর্ক নেই। কেন এটা করা হচ্ছে, আমার বোধগম্য নয়। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনী বাজেট বলে এখন আর কিছু নেই, বরং দেশে ভোট চুরির প্রকল্প চলমান রয়েছে। গত ৩০ বছর সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। ব্যাষ্টিক অর্থনীতিও ভালো অবস্থায় ছিল। ডলার বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার কারণে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা যাবে না। ৭০-৭৫ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে। যা মূল্যস্ফীতিকে বৃদ্ধি করছে। রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) টাকা দেয়া হয়েছে, যা পাচার হয়েছে।
তিনি বলেন, রিজার্ভের অর্থ অপব্যবহার করা হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তার কাজ করতে পারছে? লোনের টাকা পাচার হচ্ছে, স্টক মার্কেট লুট করছে, তা আর ফেরত আসছে না। ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক খবরদারি করতে পারছে না। ভোট চুরি করে ক্ষমতা দখল করলে জনগণের জবাবদিহিতার সুযোগ থাকে না।
বিগত দিনে ১০০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে উল্লেখ করে আমীর খসরু আরও বলেন, যারা পাচার করছেন, তাদের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। আমেরিকা থেকে রেমিট্যান্স বেড়ে গেছে। পাচারকৃত টাকায় কর দেয়ার পরিবর্তে প্রণোদনা নিচ্ছেন। বর্তমানে মোট করের ৩২ শতাংশ হচ্ছে ভ্যাট। কিন্তু যখন আমরা প্রবর্তন করেছিলাম, তখন আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছিল। আমাদের সময় প্রাইভেট সেক্টর সাপোর্ট দিয়েছিলাম। বর্তমানে আমরা কঠিন সময়ের মধ্যে পড়ে গেছি।
সেমিনারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বাজেট এখন প্রস্তাবিত। এটা খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। বাজেট সরকার তৈরি করছে। রবীন্দ্রনাথের একটা কথা আছে, অবহেলার চেয়ে আঘাত উত্তম। আমাদের বাজেট যে অবহেলিত নয়, সেটা বড় বিষয়। আরও আঘাত আসবে, কিন্তু অবহেলা চাই না।
মন্ত্রী বলেন, মুদ্রাস্ফীতি বাজেটের সঙ্গে সম্পর্ক নয়। এটা চলমান রয়েছে। সত্যি কথা হলো, আমরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। বিশেষ করে ৩০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সামাজিক সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন খাতে ভাতা ও আওতা বাড়িয়েছি। তাদের সুবিধার জন্য কম দামে পণ্য সরবরাহ করছে সরকার। বিদ্যুতের সংকট সাময়িক। মাঝে একটি সমস্যা ছিল, আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে। যেকোনো বিষয়ে এটা হতে পারে। হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে বিদ্যুৎ পৌঁছি দিয়েছি এটা কি ক্রেডিট নয়।
আয়কর রিটার্নে ২ হাজার টাকা করের বিষয়ে তিনি বলেন, ট্যাক্স রিটার্নে ২ হাজার টাকা সবার জন্য নয়। সরকারি ৪০ ধরনের সেবা যারা নিতে যাবেন, তাদের জন্য ন্যূনতম ২ হাজার টাকা। সাধারণ মানুষের জন্য নয়। তারপরও যদি এটা নিয়ে সমস্যা তৈরি করে, নাও হতে পারে। এক সময় ভ্যাট নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল, এটা এখন বাস্তবায়িত।