পাহাড়ে ১৩০ চুল্লিতে গাছ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি, হুমকিতে পরিবেশ
উপজেলার ১৩০ চুল্লিতে গাছ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করা হয়। এসব চুল্লি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রথম নিউজ, খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ির মানিকছড়ির পাহাড় থেকে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছপালা। অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব গাছ কেটে তা পুড়িয়ে উৎপাদন করছেন কয়লা। উপজেলার ১৩০ চুল্লিতে গাছ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করা হয়। এসব চুল্লি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল, বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পরিবেশ, বন্যপ্রাণী ও পাখি। সেই সঙ্গে হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য, কমে যাচ্ছে জমির উর্বরতা। বছরের পর বছর পরিবেশ বিধ্বংসী এমন কাজ চললেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন।
উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে একাধিক ব্যবসায়ী ও চুল্লি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে ঢাকাইয়া শিবির এলাকায় প্রথমে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি ও বিক্রি শুরু হয়। ধীরে ধীরে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে একশ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। একসময় ওই এলাকায় কাঠ সংকট দেখা দেওয়ায় ডাইনছড়ির ঘনবসতিপূর্ণ জনপদ বাঞ্চারামপাড়া ও মাস্টারঘাটার কয়েকটি পাহাড়ের গাছ কাটা শুরু হয়। অথচ সেখানে রয়েছে শত শত পরিবারের বসতি। ঘন ঘন বাড়িঘর থাকা সত্ত্বেও অনেক বাড়ির উঠানে গাছ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির চুল্লি বসানো হয়। এসব চুল্লিতে বছরের পর বছর পোড়ানো হচ্ছে বনের ও বাগানের গাছ।
গাছ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন এলাকার প্রভাবশালী মো. নজির আহম্মদ, আবদুর রাজ্জাক, মো. নূর ইসলাম, মো. আকতার হোসেনসহ আরও অনেকে। এসব ব্যবসায়ী জানান, শুধু মানিকছড়ি উপজেলায় কয়লা তৈরির চুল্লি আছে ১৩০টি। মাসে এসব চুল্লিতে গড়ে গাছ পোড়ানো হয় অন্তত ৬০০ মণ। সব চুল্লিতে প্রতি মাসে গড়ে ৭৮ হাজার মণ গাছ পুড়িয়ে তৈরি করা হয় কয়লা। স্থানীয়রা জানান, গত ১০ বছর ধরে অবাধে গাছ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করা হচ্ছে। এতে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পরিবেশ। এরপরও ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন।
কয়লা তৈরিতে জড়িত নুরুল ইসলাম, হাশেম মিয়া ও অংলা মারমা জানান, প্রতি চুল্লিতে মাসে চার বার কয়লা উৎপাদন করা হয়। প্রতি চুল্লিতে প্রত্যেকবার অন্তত ১৫০ মণ গাছ পোড়ানো হয়। ৭০ টাকা মণ হিসাবে প্রত্যেকবার চুল্লিতে ১০ হাজার টাকার গাছ পোড়ানো হয়। কেউ কেউ আরও বেশি গাছ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করেন। প্রতি চুল্লি থেকে প্রত্যেকবার কয়লা উৎপাদন হয় ১৫-১৬ মণ। প্রতিমণ কয়লা ১২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। শ্রমিক ও যাতায়াতসহ অন্যান্য খরচ বাদে মাসে চুল্লি প্রতি লাভ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাটনাতলী ইউনিয়নের কয়েকজন বাসিন্দা বলেছেন, কয়লা ব্যবসায়ীরা বৈধ-অবৈধ সব পথেই গাছ সংগ্রহ করছেন। কয়লা তৈরির পর ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করছেন তারা। কয়লা ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস পান না। কয়লা ব্যবসায়ী ও বাটনাতলী ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সদস্য মো. নূর ইসলাম বলেন, ‘আমরা গাছের পরিত্যক্ত অংশ লাকড়ি হিসেবে কিনে চুল্লিতে পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করি। পরে কয়লা বিক্রি করি। এতে পরিবেশের ক্ষতি কীভাবে হয় তা বুঝি না। এই ব্যবসায় অপরাধের কিছু তো দেখছি না।’
অপর ব্যবসায়ী মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘দীর্ঘদিন এই ব্যবসা করলেও তা অবৈধ কিনা সে বিষয়ে কখনও কেউ কিছুই বলেনি আমাদের। সম্প্রতি এক ব্যবসায়ী কয়লা কিনে ট্রাকযোগে সমতলে নেওয়ার সময় অবৈধ কাঠ থাকায় সেনাবাহিনী ও বন বিভাগ তা আটক করে মামলা দিয়েছে। অবৈধ কাঠ থাকার কারণে মূলত ট্রাকটি আটক হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু আমরা বৈধভাবে ব্যবসা করছি।’
এ বিষয়ে উপজেলার গাড়ীটানা বন বিভাগের বন কর্মকর্তা উহ্লামং চৌধুরী বলেন, ‘এলাকায় সিন্ডিকেট করে সংঘবদ্ধ একটি চক্র চুল্লিতে গাছ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করছে। বিষয়টি গত কয়েক মাস আগে নজরে এসেছে আমাদের। গত ১৬ ডিসেম্বর গোপন তথ্যের ভিত্তিতে এক ট্রাক প্রায় ৮০-৮৪ মণ কয়লাসহ একটি ট্রাক জব্দ করে বন আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা বন বিভাগকে তথ্য দিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো আমরা।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তামান্না মাহমুদ বলেন, ‘পাহাড়ি জনপদে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কেউ গাছ পুড়িয়ে কয়লা উৎপাদন করছে এমন তথ্য আগে কেউ দেয়নি আমাদের। জনপ্রতিনিধি কিংবা স্থানীয়রা তথ্য দিলে অনেক আগেই কয়লা তৈরির চুল্লি ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতো। এখন যেহেতু আমরা তথ্য পেয়েছি যেকোনো দিন অভিযান চালানো হবে।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews