পোশাক খাতে নিয়মকানুন না মানলে নিষেধাজ্ঞা-জরিমানা হতে পারে: ইইউ রাষ্ট্রদূত
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মঙ্গলবার ‘আইনের যথাযথ পরিপালন’ বিষয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ-এর কর্মকর্তারা এসব কথা বলেন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: পোশাক খাতে বাংলাদেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) যথাযথ নিয়ম (ডিউ ডিলিজেন্স) পালন করতে হবে। এর মধ্যে মানবাধিকার, শ্রমিকের অধিকার, নিরাপত্তা এবং কাজের পরিবেশ সুরক্ষা অন্যতম। এসব নিয়ম না মানলে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা ও জরিমানা আদায়ে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করা হবে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মঙ্গলবার ‘আইনের যথাযথ পরিপালন’ বিষয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ-এর কর্মকর্তারা এসব কথা বলেন।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি) এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এ সময় দেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা বলেন, যথাযথ নিয়ম পালনের জন্য পণ্যের দাম বাড়াতে হবে। আইবিএফবির সভাপতি হুমায়ুন রশীদের সভাপতিত্বে গোলটেবিল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকায় ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডেপুটি হেড অব ইইউ মিশন বার্নড স্প্যানিয়ার। অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান, নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এবং আইবিএফবি সহসভাপতি এমএস সিদ্দিকী।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, মানবাধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো মানতে একগুচ্ছ নিয়মকানুন তৈরি করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো। নিয়ম না মানলে উৎপাদক, ক্রেতা ও ব্র্যান্ড- যে কাউকেই দেওয়া হতে পারে নিষেধাজ্ঞা বা আরোপ করা যেতে পারে বড় ধরনের জরিমানা।
আলোচনা অনুষ্ঠানে ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ডিউ ডিলিজেন্স আইন করা হয়েছে, তা শুধু ক্রেতা-বিক্রেতার বিষয় না; সরবরাহ শৃঙ্খলে যুক্ত সবার পালনের জন্যই তা করা হয়েছে। এসব নিয়মকানুনের মধ্যে শিশুশ্রম, বাধ্যতামূলক শ্রম, দাসত্ব, বন ধ্বংস, পরিবেশদূষণ, ইকোসিস্টেমের ক্ষতি করা এবং মানবাধিকারের মতো বিষয় রয়েছে। সুতরাং এসব শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নের একার স্বার্থ নয়, এর সঙ্গে বৈশ্বিক স্বার্থ যুক্ত।
ডিউ ডিলিজেন্স বিধিবিধানগুলো আলাদা হিসাবে দেখা ঠিক হবে না উল্লেখ করে চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ২০২৬ সাল নাগাদ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশকে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তাই ডিউ ডিলিজেন্স আইনকে আলাদা হিসাবে দেখা ঠিক হবে না। এ সম্পর্কিত প্রায় ৩২টি কনভেনশন রয়েছে। বাংলাদেশকে এগুলো শুধু অনুসমর্থন নয়, বরং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেশকিছু বিধিবিধান পাশ হয়েছে। যদিও এসবের মূল সারমর্ম প্রায় একই। এরপরও প্রতিটির জন্য আলাদা নিরীক্ষা করতে হয়। এটি নিঃসন্দেহে সময় ও আর্থিক দিক থেকে টেকসই না। সুতরাং আইনগুলো সর্বজনীন ও বৈশ্বিকভাবে পালনযোগ্য হওয়া উচিত।
ফারুক হাসান আরও বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে টেকসই ও নৈতিক চর্চা পালন করা হচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, এটি একক কোনো কাজ নয়, এ প্রক্রিয়াকে সফল করতে হলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সমর্থন প্রয়োজন। ক্রেতাদের মধ্যে পণ্যের কম দাম দেওয়ার জন্য এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতা রয়েছে। ব্যবসা ক্ষেত্রে এ ধরনের অসদাচরণ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
মূল বক্তব্যে বার্নড স্প্যানিয়ার বলেন, স্থানীয় দুর্বল নিয়ম ও কম দামে ক্রয়াদেশ নেওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ খাতে অনেকেই নিয়মকানুন মেনে চলেন না। আমরা বাংলাদেশে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা এবং করোনার সময় কিছু ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের অদায়িত্বশীল আচরণ দেখেছি। এসব ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বেচ্ছায় নিয়মকানুন মানছে না। এজন্য সরবরাহ খাতে সুশাসন থাকা প্রয়োজন। এ বাস্তবতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কিছু আবশ্যক পালনীয় আইন বাস্তবায়ন করছে।’
তিনি বলেন, ডিউ ডিলিজেন্স বাধ্যবাধকতা দুভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথমত, মানবাধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হলে ভুক্তভোগী যে কেউ নির্দিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় আদালতে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, ইইউ-এর তদারককারী কর্তৃপক্ষগুলো নিজেরাই পর্যবেক্ষণ করবে যে সরবরাহ শৃঙ্খলে কেউ নিয়ম ভাঙছে কি না। যথাযথভাবে নিয়ম না মানলে ইইউ কর্তৃপক্ষ যে কোনো নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, যার আর্থিক মূল্য ওই কোম্পানির বৈশ্বিক আয়ের ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। বর্তমান আর্থিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের উৎপাদকদের পক্ষে এত ধরনের পরিপালন মেনে চলা সম্ভব নয় বলে জানান আইবিএফবি সহসভাপতি এমএস সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বে সামাজিক ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স একেক অঞ্চলে একেক রকম। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমরা সবচেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করছি, অথচ আমাদের ওপর একের পর এক নিয়মকানুনের বোঝা চাপানো হচ্ছে। বর্তমান বৈশ্বিক আইনগুলো প্রয়োজনীয় সংশোধন করে একক ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।’ সব অঞ্চলের জন্য একক নিয়ম চেয়েছেন অন্য ব্যবসায়ী নেতারাও।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘দাম নিয়ে সব সময়ই আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। ক্রেতা দেশগুলোর বিভিন্ন আইনের পরিপালনের লক্ষ্যে কয়েক ধরনের অডিট পদ্ধতি মেনে চলতে হয় উৎপাদকদের। এতে ব্যবসার সময় ও খরচ অনেক বেড়ে যায়। এসব অডিট পদ্ধতিকে একত্রীকরণ করা প্রয়োজন।’
বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘বিভিন্ন বিধিবিধানের পরিপালন করতে আমাদের মূলত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেই সনদ নিতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য এটা বড় ধরনের ব্যবসা। আমরা সব ধরনের শর্ত মানলেও পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাই না। সুতরাং সব কমপ্লায়েন্স মানার শর্ত দিলে, এই ভারী বোঝা বহনের শক্তিও আমাদের দিতে হবে। অর্থাৎ পণ্যের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে।’
এ বিষয়ে ডেপুটি হেড অব ইইউ মিশন বার্নড স্প্যানিয়ার বলেন, দাম নির্ধারণ হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে নেগোসিয়েশনের বিষয়। এ বিষয়ে আমরা কাউকে বাধ্য করতে পারি না।
অন্যদিকে ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যে একটি একক অডিট পদ্ধতির কথা বলছেন, এটি একটি ভালো প্রস্তাব। আমরাও এটি নিয়ে কথা বলব। তবে বাংলাদেশের অবশ্যই সরবরাহ শৃঙ্খলে নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।