পাচারকৃত অর্থ ফেরত: অর্থ পাচারে বিচারের মুখে এস আলম-সাইফুজ্জামান
সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
প্রথম নিউজ, অনলাইন : দেশ থেকে নজিরবিহীনভাবে অর্থ পাচারের সবচেয়ে বড় দুটি ঘটনা শিগগির আদালতে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও এস আলমের (সাইফুল আলম) অর্থ পাচার। এসব সংস্থার মাধ্যমে শিগগির বিষয়টি আদালতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আদালতে যাওয়ার পরই বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। সেইসঙ্গে যুক্তরাজ্যেও আইনজীবী নিয়োগের কাজ শুরু হয়েছে।
এরই মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। গত বৃহস্পতিবার সিআইডির মিডিয়া উইংয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও অভিযোগের ভিত্তিতে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের অনুসন্ধান শুরু করেছে সিআইডি। এতে বলা হয়, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিজের ও স্ত্রী রুখমিলা জামানের নামে যুক্তরাজ্য ও দুবাইয়ে ৮টি প্রতিষ্ঠান খোলেন, যার স্থায়ী ও চলতি সম্পদের মূল্য ২১ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার ডলার। ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি, রোলস রয়েস গাড়িও রয়েছে তার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত যে ২১টি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে, সেই তালিকায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী বা তার পরিবারের কারও নাম নেই। ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী যে সম্পদ বিবরণী জমা দেন, সেখানে তার বিদেশে থাকা সম্পদের কোনো তথ্য নেই। এর আগে এস আলম ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের কাজ শেষ করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করেছে সিআইডি।
জানা গেছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলম মাসুদের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়া ছাড়াও অর্ধশতাধিক প্রভাবশালীর সম্পদ জব্দ ও পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান আছে। এই তালিকায় আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীসহ অনেকে। বিএফআইইউর তথ্যের ভিত্তিতে দুদকের প্রাথমিক গোয়েন্দা অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ থাকার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এবং তা বিদেশে পাচার করেছেন। এই অর্থ কোথায় কোথায় পাচার হতে পারে, তার সম্ভাব্য গন্তব্য চিহ্নিত করে অর্থ পাচারের তথ্য জানতে ১০টি দেশের সঙ্গে সম্প্রতি চুক্তি করেছে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও সুইজারল্যান্ড। বিএফআইইউ সূত্রে জানা গেছে, পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি নামে এই চুক্তির মাধ্যমে ওইসব দেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য আনা যাবে, যা পরবর্তী সময়ে আদালতে হাজির করা হবে।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়েক শতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বিএফআইইউর মধ্যে ব্যাংক হিসাব শনাক্ত ও জব্দ করা হয়েছে, যা এখনো চলমান আছে। একই সঙ্গে এদের অবৈধ অর্থ-সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। দুদক সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে অন্তত ৫২ জনের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে শিগগির তাদের বিরুদ্ধে সম্পদ জব্দের আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর শুরু থেকেই দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছেন। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেটিই হোক, যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের ফাঁকে অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর এই বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওয়াশিংটন থেকে ফিরেই অর্থ পাচার প্রতিরোধে গঠিত টাস্কফোর্সকে পাচারের টাকা ফেরানোর কাজের গতি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। গত বুধবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে গভর্নর পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে অগ্রাধিকার দিয়ে কোন কাজগুলো করতে হবে, তা নিয়ে আলোচনা করেন। বৈঠকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক মহল পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে কারিগরি সহায়তা দেবে জানিয়ে গভর্নর বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব রয়েছে। সেজন্য আন্তর্জাতিক মহলের সাহায্য নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদালতে যাওয়া মানেই বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়া। এর ভালো ও মন্দ দুটো দিকই রয়েছে। ভালো দিক হচ্ছে, পাচারের অর্থসংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে ফেরত আনতে গেলে অবশ্যই নিজ দেশে বিচারের রায় দেখাতে হবে। সেই প্রক্রিয়া এখন শুরু হচ্ছে। মন্দ দিক হচ্ছে, দেশে বিচারিক প্রক্রিয়া মানেই দীর্ঘসূত্রতা। কেননা তাড়াহুড়া, প্রস্তুতির অভাব ও অদক্ষতার কারণে সঠিক ফল না আসার অনেক নজির আছে। সেটা যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন তারা।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আদালতে গেলে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ হবে। তবে এদের আদালতে দিতে হবে, তা-ও ঠিক। আদালতে দেওয়ার ফলে ভালো সমাধান আসবে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে।
বিএফআইইউ সূত্রে জানা গেছে, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে পাঁচটি ধাপ আছে। প্রথম ধাপে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা। দ্বিতীয় ধাপে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা। তৃতীয় ধাপে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে অভিযোগের তদন্ত করা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। চতুর্থ ধাপে আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করা এবং শেষ ধাপে অর্থ আদায় করা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএফআইইউর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, অর্থ পাচারের বিষয়ে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে এবং তিনি যেখানে পাচার করেছেন, সেখান থেকে যে কোনো মাধ্যমে সঠিক তথ্যটি পেতে হবে। সেখানকার তথ্য পাওয়ার পর দুই দেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পারস্পরিক তথ্য বিনিময় করবে। কিন্তু এসব গোপন তথ্য আদালতে দেওয়া যায় না। তাই মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্সের অনুরোধ করতে হয়। সেটা দিয়ে আদালতে উপস্থাপনের মতো করে তথ্য আনতে হয়।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ওই অনুরোধের পর পাওয়া তথ্য আদালতে উপস্থাপন করে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ ফ্রিজ বা জব্দ করাতে হয় এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে সেই তথ্য পাঠিয়ে সেখানকার আদালতেও ফ্রিজ বা জব্দ করাতে হয়। সে পর্যন্ত যাওয়া গেলে পাচার হওয়া অর্থ আনার ক্ষেত্র তৈরি হয়। তবে এর পরও দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা ও কিছু ক্ষেত্রে চুক্তির বিষয় আছে। যে দেশে টাকা পাচার হয়েছে, সেখানে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গেলে এবং তারা সহযোগিতা করলে টাকা ফেরত আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সবকিছু কাজে লাগিয়ে দেশের আদালতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় হলে তা যে দেশে পাচার হয়েছে, সেই দেশে পাঠাতে হয়।
অর্থ ফেরত দেওয়া নিয়ে যদি সেই দেশের আপত্তি বা আইনি জটিলতা না থাকে, তাহলে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসবে। এটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া কি না জানতে চাইলে সেই কর্মকর্তা বলেন, সে ক্ষেত্রে উভয় দেশের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা বড় বিষয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এর কোনোটারই ঘাটতি নেই। অতীতে এই দুটো বিষয়ের ঘাটতি ছিল বলেই টাকা ফেরত আসেনি। এবার অবশ্যই আসবে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, আদালতে তো যেতেই হবে। এই টাকা দেশে নেই। অন্যান্য দেশে আছে। সেই দেশের সঙ্গে যখন আলোচনা হবে, তখন তো নিজ দেশের বিচারের নথি দেখাতে হবে। কাজেই আদালতে টিকবে সে রকম তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আদালতে যাচ্ছে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। পাচারের অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, প্রাথমিক কাজটা সাফল্যের সঙ্গে শেষ করতে হবে। তা না হলে সফলতা আসবে না। তড়িঘড়ি করে কিছু কাগজপত্র জমা দিয়ে আদালতে যাওয়া হলে ফল ভালো হবে না। এ রকম অনেক নজির আমাদের দেশে আছে।
বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার আগ্রহ: বাংলাদেশ থেকে গত কয়েক বছরে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তা নজিরবিহীন বলে মনে করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক এসব তদন্ত সংস্থা নিজে থেকেই এ বিষয়ে কারিগরি সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রয়োজন হলে যে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। শুধু বিশ্বব্যাংক নয়, যুক্তরাজ্য সরকার, আইএমএফ, এডিবি, ইউএস ট্রেজারি, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)—সবাই সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারের কাজে সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলোর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে ইতিবাচক মনোভাবের কমতি নেই। এত আগ্রহের কারণ জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এমন নজিরবিহীন অর্থ পাচারের ঘটনা বিশ্বের আর কোনো দেশে নেই। ফলে এখানে কাজ করা মানেই ব্যাপক অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হওয়া। এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে এসব তদন্ত সংস্থা।