ন্যায্যতা, স্বচ্ছতার জন্য প্রতিবাদ: বাংলাদেশি তরুণরা জবাবদিহি চায়
ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরের পর্যালোচনা
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: বাংলাদেশের তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে প্রাধান্য পেয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধ, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির লড়াই। এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রী প্রাপ্তি তাপসী এই নতুন লড়াইয়ের একটি মুখ হয়ে উঠেছেন: ন্যায়যুদ্ধের লড়াই। তিনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এই জুলাইয়ে রাস্তায় নেমে আসা তরুণ ছাত্রদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য সরকারি চাকরির কোটার প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। কিন্তু বিক্ষোভ যেমন বেড়েছে, তেমনি প্রতিবাদকারীদের দমাতে সহিংসতাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।
তাপসী নিজেও এই অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ১৬ জুলাই থেকে প্রায় ২০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাপসীর তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাদের মধ্যে ছিলেন, বাংলাদেশের মানুষ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে হিংসাত্মক সপ্তাহগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন। যখন সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে, সৈন্য মোতায়েন করে এবং দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে বিশৃঙ্খলার প্রতিক্রিয়া জানায়- তখন হাতে মশাল নিয়ে অন্যান্য তরুণীদের সামনে দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় ক্ষুব্ধ তাপসীকে।
তিনি বলেন, ‘বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিন দিন বেড়েই চলেছে।' তার কথায় ভয় এবং ক্রোধ উভয়ই প্রকাশ পেয়েছে। বিক্ষোভের সময় তার কব্জিতে আঘাত লেগেছিল। তাপসীর কথায়, ‘শান্তিপূর্ণ, ছাত্র-কেন্দ্রিক এবং অরাজনৈতিক প্রতিবাদ কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের রূপ নিয়েছে।’ তরুণদের জন্য বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবের পটভূমিতে এই প্রতিবাদ, নীতিগত প্রশ্নের থেকেও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্টারিওর ওয়াটারলুতে বালসিলি স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের নীতি ও অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার সাদ হাম্মাদি বলেছেন যে, ‘এটি এখন মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর বাধা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণের বিরুদ্ধে ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠেছে। এটি ন্যায্যতার জন্য একটি প্রতিবাদ। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার জন্য একটি প্রতিবাদ’।
অশান্তির মূল
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা ও আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে কোটা পদ্ধতি চালু করেন। যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০%, সরকারি চাকুরীর পাশাপাশি নারীদের জন্য ১০ % এবং সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীগুলোর জন্য ৪০% কোটার কথা বলা আছে। এটি ১৯৯৭ এবং ২০১০ সালে প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বাড়ানো হয়েছিল– যার ফলে কোটা ব্যবস্থা একটি অভিজাত শ্রেণিকে বাড়তি সুযোগ পাইয়ে দিয়েছে এমন ধারণার জন্ম দেয়। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। সরকার সেই ব্যবস্থা বাতিল করে। তারপরে ২০২৪ সালের জুনে হাইকোর্ট কোটা বাতিলকে অবৈধ ঘোষণা করে প্রতিবাদের একটি নতুন তরঙ্গের জন্ম দেয় যা ১ জুলাই একটি বিশাল বিক্ষোভে পরিণত হয়। এক সপ্তাহ পর বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতাসিন দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভের মূল কারণ চাকরির অভাব। অনেক ধুমধাম করে বাংলাদেশ ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে স্নাতক হওয়ার পথে। কিন্তু দেশের সবাই উপকৃত হয়নি। তরুণরা ১২.৫ % বেকারত্বের হারের সম্মুখীন যা সামগ্রিক হারের তিনগুণ। এর মধ্যেই কোটা ব্যবস্থার পুনর্বহাল তাদের মধ্যে বিরক্তির জন্ম দিয়েছে, তরুণদের দাবি এর মাধ্যমে তারা ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
প্রাথমিকভাবে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ১৪ জুলাই সহিংস হয়ে ওঠে শেখ হাসিনার একটি মন্তব্যকে ঘিরে। রাজাকার একটি অবমাননাকর শব্দ যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সমর্থনকারী বাংলাদেশিদের বোঝায়। প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন - 'মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা না পেলে রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে?'
তাপসী এই অভিযোগ উড়িয়ে দেন। কারণ তার কাছে ‘রাজাকার’ শব্দটি ছিল গভীরভাবে অপমানজনক এবং অনেক তরুণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনীতিকরণে ক্লান্ত। হাম্মাদি বলছেন, ‘আমি মনে করি তরুণ প্রজন্মের অসন্তোষ হলো সরকারের তৈরি করা ‘আমাদের বনাম তাদের’ এই বিভাজনের বিরুদ্ধে। কীভাবে সরকার দেশের প্রতি ভালোবাসাকে সংজ্ঞায়িত করে তার বিরুদ্ধে। দেশের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তোলার জন্য, জনগণের কথা শোনা, তাদের জন্য দেশের ইতিহাস লালন করার জায়গা তৈরি করা এবং একটি রাষ্ট্র যে সুযোগ দিতে পারে তা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তে আমরা দেখেছি অনেক তরুণকে ভালো কাজের সন্ধানে দেশের বাইরে যেতে হয়েছে।’
১৮ এবং ১৯ জুলাই দুটি মেট্রো স্টেশনে আগুন লাগানোর পাশাপাশি একটি প্রধান ডাটা সেন্টার, দেশের বৃহত্তম সম্প্রচারকারী বিটিভির সদর দফতর এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি সরকারি ভবন ভাঙচুর করা হয়েছিল। যদিও ছাত্র বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুরের দায় অস্বীকার করেছে। ভিড় সামলাতে নিরাপত্তা বাহিনীকে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার গ্যাস এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এটিই প্রথম প্রতিবাদ নয় যার মুখোমুখি হয়েছেন শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালে কোটা নিয়ে বিক্ষোভ এবং সড়ক নিরাপত্তার জন্য একটি ছাত্র-নেতৃত্বাধীন মিছিল সরকারকে নাড়া দিয়েছিল। ২০২০ সালে নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবেলাসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাস্তায় নেমেছিলেন বাংলাদেশিরা। তাপসীসহ আজ মিছিলে অংশ নেয়া এই ছাত্রদের অনেকেই সেদিনের বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভের বর্তমান প্রকৃতি অনেক বেশি মারাত্মক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনোশ চৌধুরী বলেন, “সহিংসতা সবসময়ই অজ্ঞতা ও অহংকারের বহিঃপ্রকাশ । ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলন ও সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের সময়ও শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের আচরণে অহংকার প্রকাশ পেয়েছিলো।'
স্বাভাবিক অবস্থা কবে ফিরবে?
সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ বংশধরদের জন্য কোটা অবশ্যই ৩০% থেকে নামিয়ে ৫% করতে হবে- এটি বিক্ষোভকারীদের জয়। ইন্টারনেটও এই সপ্তাহে আংশিকভাবে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে এবং স্কুলগুলো বন্ধ থাকলেও ঢাকার রাস্তায় স্বাভাবিক জীবনের লক্ষণ ফিরে এসেছে। এখন, বিক্ষোভকারীরা সরকারকে ছাত্র ও বিরোধী নেতাদের ব্যাপক ধরপাকড় বন্ধ করার দাবি করছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সিনিয়র ফ্যাকাল্টি এবং একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সেলিম রেজা নিউটন বলেছেন, “রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সহিংসতা সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য ছিল। একটি সর্বগ্রাসী সরকার প্রায়ই যুক্তিযুক্ত এবং শান্তভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, বিশেষ করে যখন সেই সরকার একটি গণ প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়। কারণ তা শাসনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে।'
উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, ‘যে মুহূর্তে সরকার কঠোরভাবে দমনপীড়ন শুরু করে, সেই মুহূর্ত থেকে এই আন্দোলন বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে দূরত্ব তৈরি করেছে । আর তাই এটি রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন এবং আরও বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে সরকারের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে একটি বৃহৎ আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।’
যদিও শেখ হাসিনার সরকার বিক্ষোভকারীদের দাবি কতটা মেনে নেবে তা স্পষ্ট নয়। কর্তৃপক্ষ বলেছে যে সরকার গত সপ্তাহের ঘটনা তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে - যার মধ্যে সরকারি হতাহতের পরিসংখ্যান নির্ধারণ করা রয়েছে। তবে এটি বিক্ষোভকারীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। বাংলাদেশি যুবক, যারা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার, তারা বলছে আন্দোলন থেকে তারা এখনই সরে আসবে না।
তাপসী মনে করেন, 'এতো রক্ত ঝরানোর আগেই আলোচনা এবং শান্তিপূর্ণ সমাধান করা সম্ভব ছিল। এই কর্তৃত্ববাদী সরকারকে তরুণদের বিতৃষ্ণার মুখে পড়তে হতো না। তার পরিবর্তে জনগণ যেভাবে সশস্ত্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নিরস্ত্র ছাত্র ও বেসামরিক মানুষকে হত্যা করতে দেখেছে... এই সরকার কখনই বাংলাদেশের জনগণের আস্থা, সমর্থন বা সম্মান ফিরে পাবে কিনা এ নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।