নতুন কারিকুলাম পাঠদানে স্মার্ট ক্লাসরুম স্থাপন অনিশ্চিত
এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল নির্ধারিত হয় জুলাই ২০১৬ থেকে জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেওয়ায় ক্রমশই পেছাচ্ছে বাস্তবায়নকাল।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম চালু হচ্ছে। গতানুগতিক শিক্ষার বাইরে বাস্তবভিত্তিক কারিকুলামের আদলে তৈরি হচ্ছে পাঠ্যবই। দেশের ৩২ হাজার বিদ্যালয়ে তৈরি করা হবে ডিজিটাল ক্লাসরুম। এজন্য মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও স্মার্ট ক্লাসরুমের ডিজাইন নির্ধারণ করে সংশোধিত প্রকল্পে যুক্ত করার কথা থাকলেও নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্তের কারণে ঝুলে আছে প্রকল্পটির কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন আইসিটি প্রকল্পের বেহাল দশা তৈরি হয়েছে। নতুন কারিকুলামের জন্য আইসিটি প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের মেয়াদ আরও দু’বছর বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও প্রায় এক বছর ধরে সব কার্যক্রম বন্ধ। ডিজিটাল ও স্মাট ক্লাসরুম স্থাপনে আইসিটি প্রকল্পের ডিপিপিতে কিছুটা সংশোধন করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠালে তারা সেখানে কিছু কোয়ারি (সংশোধনী) দিয়েছে। সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। সেটি অনুমোদন হওয়ার পর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সারাদেশে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান আধুনিকায়নসহ দক্ষ এবং নতুন কারিকুলামের ওপর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীনে বাস্তবায়িত হচ্ছে ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প’। এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল নির্ধারিত হয় জুলাই ২০১৬ থেকে জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেওয়ায় ক্রমশই পেছাচ্ছে বাস্তবায়নকাল। তারা আরও জানান, প্রথম দফায় ব্যয় ছাড়া প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয় জুন ২০২১ পর্যন্ত। দ্বিতীয় দফায় আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২২ সাল পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এসময়ে প্রকল্পের মোট অগ্রগতি দাঁড়ায় ২১ শতাংশ। প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করতে তৃতীয় দফায় জুন ২০২৩ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়।
জানা গেছে, ২০২৩ সাল থেকে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের ৩২ হাজার বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ক্লাসরুম তৈরিতে প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেখানে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ন্যূনতম পাঁচটি করে স্মার্ট টিভি অথবা ল্যাপটপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সে কারণে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডিপিপি পরিবর্তন করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। সেখান থেকে নতুন কিছু সংশোধনী দেওয়া হলেও মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় প্রকল্পের সব কাজ বন্ধ রয়েছে। এ প্রকল্পে ১৫ জন কর্মকর্তা ও সাতজন কর্মচারীর পদ সৃজন থাকলেও অধিকাংশ পদ শূন্য। পাঁচ মাস ধরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বন্ধ।
এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ডিজিটাল ও স্মাট ক্লাসরুম স্থাপনে আইসিটি প্রকল্পের ডিপিপিতে কিছুটা সংশোধন করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠালে তারা সেখানে কিছু কোয়ারি (সংশোধনী) দিয়েছে। সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। সেটি অনুমোদন হওয়ার পর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের ৩২ হাজার ক্লাসরুম ডিজিটালাইস করতে হলে সরকারি জি টু জি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। নতুবা সরকারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দরপত্র আহ্বান, উপদেষ্টা নিয়োগ, নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক সময় ক্ষেপণ হয়। ফলে আগামী বছরের শুরু থেকে নতুন কারিকুলামের জন্য স্মার্ট ক্লাসরুম স্থাপন করা সম্ভব হবে না। এদিকে, সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পরিদর্শনে প্রকল্পটির ধীরগতির বিষয়টি উঠে আসে। আইএমইডির প্রতিবেদন মতে, প্রকল্পটি ২০১৬ সালে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২০১৭ সালে। কর্মকর্তা ও কনসালটেন্ট নিয়োগেও বিলম্ব হয়েছে। দরপত্র বাতিল, বিস্তারের রিট মামলা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাল্টিমিডিয়া সামগ্রী সরাসরি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত থাকলেও ২০১৯ সালে ল্যাপটপ সরাসরি ক্রয় (ডিপিএম) এবং অন্যান্য সামগ্রী উন্মুক্ত দরপত্রের (এটিএম) মাধ্যমে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এ সিদ্ধান্তের ফলে জটিলতার সৃষ্টি হয়, পরে ক্রয় প্রক্রিয়ার আর অগ্রগতি হয়নি। ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষের উপকরণ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয় এবং নভেম্বর ২০২১ সালে তা চূড়ান্ত হয়। আরডিপি অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ সৃজনের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং স্মার্ট ক্লাসরুমের মডেল বা ডিজাইন নির্ধারণ করে সংশোধিত প্রকল্পে যুক্ত করতে বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর মতবিনিময় সভায় মার্চ ২০২০ সালে এ সিদ্ধান্ত হয়। এসব বিষয়ে কম্পোনেন্ট নির্বাচিত করে প্রকল্প দলিল (আরডিপিপি) প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়। তবে তারপর এ বিষয়ে কোনো কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি, ফলে প্রকল্পের অগ্রগতি কম।
প্রকল্প কার্যালয় থেকে জানানো হয়, ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নতুন করে আরও দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তার আগে ডিপিপি সংশোধন করতে হবে। সেটি হলে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠানো হবে। বর্ধিত সময়ে প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও আরডিপিপি অনুমোদন হওয়ার আগে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ করা সম্ভব হবে না। প্রকল্প বাস্তবায়নের চার বছরে পাঁচজন ছয় ধাপে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সর্বশেষ ৫ মে ২০২১ সাল থেকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক ড. মো. মোরশীদুল হাসান।
তিনি বলেন, ডিপিপিতে নীতিনির্ধারণী সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের পক্ষে কোনো কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির পর যে প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল ক্লাসরুমের সরঞ্জাম কেনার নির্দেশনা দেওয়া হবে সে পদ্ধতি অনুসরণ করে কেনা হবে। তবে এজন্য অনেক সময় প্রয়োজন হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের ৩২ হাজার ক্লাসরুম ডিজিটালাইস করতে হলে সরকারি জি টু জি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। নতুবা সরকারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দরপত্র আহ্বান, উপদেষ্টা নিয়োগ, নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক সময় ক্ষেপণ হয়। ফলে আগামী বছরের শুরু থেকে নতুন কারিকুলামের জন্য স্মার্ট ক্লাসরুম স্থাপন করা সম্ভব হবে না। এতে রাস্তায় চাকা ছাড়া গাড়ি চালানোর অবস্থা তৈরি হবে।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews