দীর্ঘ হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশের মিছিল, ১১ মাসে ৪৩০ বেওয়ারিশ লাশ
হত্যা, দুর্ঘটনা কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছে মানুষ। ব্যস্ত শহরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জীবিকার জন্য অনেকে ছুটে আসেন।

প্রথম নিউজ, ঢাকা: দীর্ঘ হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশের মিছিল। হত্যা, দুর্ঘটনা কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছে মানুষ। ব্যস্ত শহরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জীবিকার জন্য অনেকে ছুটে আসেন। কখনো ভাগ্যকে আবার কখনো মৃত্যুকে বরণ করে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। শুধু মৃত্যুতে শেষ নয়। মৃত্যুর পরেও দেখা মেলে না স্বজনের। ঠাঁই হয় হাসপাতাল মর্গে। শেষমেশ বেওয়ারিশ লাশের পরিচয়ে দাফন হয়। শেষ বিদায়টুকুও জানাতে পারেন না স্বজনরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শত চেষ্টায়ও মেলে না অনেকের পরিচয়। এসব লাশের দাফনের কাজ সম্পন্ন হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে। সংস্থাটি জানায়, রাজধানীতে গত ১১ মাসে ৪৩০ জনের বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়। শুধু জানুয়ারিতেই ৫৩ জন। একদিনে দাফন হয় ১৫ থেকে ২০ জনের লাশ। অজ্ঞাতনামা বেওয়ারিশ এই লাশগুলো বেশিরভাগই জলাশয়ে, মহাসড়কের পাশে নির্জন স্থানে পড়ে থাকে। খুনের শিকার লাশগুলোর আলামত নষ্ট করতে মরিয়া হয়ে ওঠে অপরাধী চক্র। কয়েকদিনের ব্যবধানে অনেকের লাশ পচে-গলে যায়। এসব লাশ শনাক্ত করতে হিমশিম খেতে হয় দায়িত্বশীলদের। অজ্ঞাত লাশের অনেকেই দুর্ঘটনা কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যুরও শিকার হয়। এই লাশগুলো বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে জুরাইন ও রায়ের বাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়। লাশের পরিচয় পেতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) টিম ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে কাজ করে। চলতি বছরের নভেম্বরের ৭ তারিখে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান ২৬ বছর বয়সী এক যুবক।
ওই যুবকের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। ঢাকা রেলওয়ে থানার (কমলাপুর) বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মো. সাকলাইন বলেন, ওই যুবকের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্তের পর পরিচয় না পেলে লাশ দাফনের জন্য হস্তান্তর করা হবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে। ১৭ই ডিসেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ময়লার স্তূপ থেকে অর্ধগলিত ও দগ্ধ অবস্থায় অজ্ঞাতনামা (২৫) এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। যাত্রাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারজানা আক্তার জানান, যাত্রাবাড়ী থানাধীন মাতুয়াইল ল্যান্ড ফিল্ডের ভেতর মান্ডা রোড এলাকায় একটি লাশ পড়ে আছে এমন খবর পেয়ে আমরা সেখানে যাই। মরদেহটি উদ্ধার করে শুক্রবার ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। ওই নারীর নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি। নারীর পরিচয় শনাক্ত না হলে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হবে।
সংস্থাটির সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ৪৩০ জন বেওয়ারিশ লাশের দাফন হয়েছে। এর মধ্যে জুরাইন কবর স্থানে ২১৫ এবং রায়ের বাজার কবরস্থানে ২১৫ জনের লাশ দাফন হয়। এ ছাড়াও গত ১১ বছরে ১২ হাজার ৯০৮ জন বেওয়ারিশ লাশের দাফন হয়। জানুয়ারি মাসেই সবচেয়ে বেশি লাশ দাফন হয়েছে। পরিবারের খবর পাওয়া যায় হাজারে ২-৩টি লাশের। অধিকাংশই বীভৎস ও বিকৃত লাশ। যাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। বেশিরভাগই ঢাকা মেডিকেল ও মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গ থেকে সংগ্রহ করা হয়। সরকার পরিচয় না পেয়ে মর্গে কিছুদিন রেখে এসব লাশকে বেওয়ারিশ ঘোষণা দেন। এরপর আঞ্জুমানকে কাগজপত্র বুঝিয়ে দেয়া হয়। প্রতিটি লাশের সঙ্গে আমাদের কাছে পুলিশের ছবি দেয়ার কথা কিন্তু এই ছবিগুলো আমরা সব সময় পাই না। পুলিশ লাশের ছবিগুলো সংগ্রহ করে। তারা ছাড়া এই ছবিগুলো অন্য কেউ তুলতে পারেন না। এই ছবিগুলো যদি সবগুলো লাশের সঙ্গে পাওয়া যায় তাহলে ভালো হয়। কোনো একজন ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে মামলা হলো তখন কিন্তু আমরা বলতে পারি না কার লাশ কোনটা। কয়েক বছর আগে একজন নারীর লাশ পাওয়া যায়। কেরানীগঞ্জ থানার অধীনে ছিল দুর্ঘটনাটি। মর্গে থেকে কাজ সম্পূর্ণ করে পরিচয় না পেয়ে বেওয়ারিশ ঘোষণা করে পুলিশ। এরপর আঞ্জুমান তাকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করে। কয়েকদিন পর ওই নারীর মৃত্যু নিয়ে একটি মামলা হয়। মামলা হওয়াতে সেই লাশটি তুলতে হবেই। কিন্তু দুঃখজনক হলো, একটি লাশের সঙ্গে ওই দিনের দাফন করা সবগুলো লাশ তুলতে হয়েছে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের ট্রাস্টি এবং সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিম বখ্শ বলেন, সরকার মর্গে থাকা লাশগুলোকে যখন বেওয়ারিশ ঘোষণা করে তখন লাশগুলো আমাদের কাছে আসে। কাগজপত্রের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করা হয়। এই বেওয়ারিশ লাশগুলোর কথা জনগণ কিন্তু জানতে পারে না। একদিনে ১৫-২০টি লাশের দাফনও করা হয়। লাশগুলো খুব বিকৃত অবস্থায় আনা হয়। বেশিরভাগ লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। সরকারিভাবে লাশের ছবি তোলা হয়। কিন্তু সব লাশের ছবি আমাদের কাছে আসে না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা খুঁজতে এলেও আমরা সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারি না। কোন কবরটা কার সেটা কিন্তু বলাও যায় না। আমাদের নিজস্ব কোনো কবরস্থান নেই। জুরাইনসহ কয়েকটি কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। এভাবে লাশের সিরিয়ালও আমাদের রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। নিজস্ব কবরস্থান হলে নাম্বারিং করে লাশগুলো ঠিকানাসহ সুরক্ষিত করে রাখা সম্ভব ছিল। স্বজনরা খুঁজতে এলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। এই বেওয়ারিশ লাশের ব্যবস্থাপনাটা আরও উন্নত করতে হবে। প্রতিদিন প্রচুর স্বজন আসে নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে। পরিচয় শনাক্ত করে স্বজনদের সঠিক তথ্য জানানো উচিত। কিছুটা হলেও তারা সান্ত্ব্তনা যেন পায়।
তাদের মৃত্যু হয়েছে নাকি হায়িয়ে গিয়েছে এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে। তিনি বলেন, মেয়র হানিফ দায়িত্বে থাকা অবস্থায় আমাদের একটি নিজস্ব কবরস্থানের জন্য বলা হয়েছিল। তিনি কয়েকটি জায়গা বাছাই করে সিটি করপোরেশনকে বলেছিলেন। কিন্তু এরপরে যারা দায়িত্বে এসেছিলেন তারা কোনো উদ্যোগ নেননি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, আমরা অজ্ঞাতনামা লাশের সন্ধান পেতে সব চেষ্টা চালিয়ে যাই। শত চেষ্টার পরও যখন তাদের পরিচয় পাওয়া না যায় তখন বেওয়ারিশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দাফনের জন্য খবর দেয়া হয়। তারা এসে হাসপাতালের মর্গ থেকে নিয়ে যান। তিনি বলেন, কোথায় কোন ডেডবডি পাওয়া যায় তার সুরতহাল প্রতিবেদন করে আমরা হাসপাতালের মর্গে পাঠাই। প্রথমে ওই লাশের ছবি সংগ্রহ করি। এরপর ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়া হয়। ডিএনএ আলামত সংগ্রহ করে সিআইডিকে পাঠানো হয়। লাশের তথ্য পুলিশ ও আদালতের কাছে থাকে। বিভিন্ন মিডিয়ায়ও প্রচার করা হয়। পরিচয় শনাক্তে আঞ্জুমান মুফিদুলকেও ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে রাখা প্রয়োজন। অনেক নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজন তাদের কাছে খুঁজতে আসেন। স্বজনরা ছবি ও পোশাক দেখেও চিনতে পারেন যদি লাশটি বিকৃত না হয়ে যায়।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: