তহবিল সংকট, বিপাকে হোমল্যান্ড লাইফের বিমা গ্রাহকরা

এ পরিস্থিতিতে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ সরকারি বন্ডে প্রতিষ্ঠানটির যে বিনিয়োগ রয়েছে, তা নগদায়ন করে গ্রাহকের দাবি পরিশোধের আবেদন করেছে।

তহবিল সংকট, বিপাকে হোমল্যান্ড লাইফের বিমা গ্রাহকরা

প্রথম নিউজ, ঢাকা: তহবিল সংকটে পড়েছে জীবন বিমা কোম্পানি হোমল্যান্ড লাইফ। ফলে কোম্পানিটির বিমা গ্রাহকরা দাবির টাকা পাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতিতে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ সরকারি বন্ডে প্রতিষ্ঠানটির যে বিনিয়োগ রয়েছে, তা নগদায়ন করে গ্রাহকের দাবি পরিশোধের আবেদন করেছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সেই আবেদন অনুমোদন করেনি। ফলে বিপাকে পড়েছেন হোমল্যান্ড লাইফের বিমা গ্রাহকরা। তারা দ্বারে দ্বারে ঘুরেও বিমা দাবির টাকা পাচ্ছেন না।

জানা গেছে, হোমল্যান্ড লাইফে কয়েক হাজার বিমা গ্রাহকের দাবির টাকা বকেয়া পড়েছে। কোম্পানির তহবিলে টাকা না থাকায় এসব গ্রাহকদের বিমা দাবির টাকা পরিশোধ করতে পারছে না কোম্পানিটি। যদিও কোম্পানিটির দাবি ২০২২ সালের মে মাসের পর ৩৫ কোটি টাকার বেশি বিমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে। অবশ্য এই বিমা দাবির টাকা পরিশোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এজন্য যে গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, তাদের পলিসির বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

সিরাজুল ইসলাম নামে হোমল্যান্ড লাইফের একজন বিমা গ্রাহক জানান, তার বিমা পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। বিমার টাকা পেতে মাসের পর মাস কোম্পানিটিতে ধর্ণা দিয়েছেন। কিন্তু দাবির টাকা পাননি। বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করেও বিমার টাকা আদায় হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমার ক্ষুদ্র সঞ্চয়। অল্প অল্প করে টাকা জমা করে হোমল্যান্ড লাইফে বিমা করি। বিমা পলিসির টাকা নিয়মিত পরিশোধ করেছি। কষ্টের টাকা দীর্ঘদিন ধরে জমা করার পর, এখন সেই টাকা ফিরে পাচ্ছি না। দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। এর থেকে কষ্ট আর কী হতে পারে? এ অবস্থা চললে বিমার প্রতি মানুষের কোনো আস্থা থাকবে না।

এদিকে আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, বিমা দাবির টাকা না পেয়ে গত এক বছরে হোমল্যান্ড লাইফের বিরুদ্ধে প্রায় ৭ হাজার গ্রাহকের আবেদন জমা পড়েছে। কোম্পানিটি গ্রাহকদের ৭৯ কোটি টাকার মতো দাবি পরিশোধ করছে না। এ পরিস্থিতিতেই হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল সম্প্রতি আইডিআরএ’র কাছে একটি আবেদন করেছেন। সেখানে তিনি দাবি পরিশোধের জন্য পর্ষদকে তহবিল বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, আপনাদের নিকট থেকে বিমা দাবি নিষ্পত্তি না করার যে অভিযোগ পাওয়া গেছে তার মধ্যে ২ হাজার ৩৮১টি বিমা দাবি বাবদ ৬ কোটি ৫২ লাখ ৪৪ টাকা নিষ্পত্তি করতে বাকি আছে। এতে বলা হয়েছে, বিগত দিনে প্রথম বর্ষ ব্যবসা ভালো না হওয়ার কারণে নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহের পরিমাণ অত্যান্ত নগন্য। প্রতিমাসে ১ কোটি টাকার সামান্য বেশি পরিমাণ নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয় এবং নবায়ন প্রিমিয়ামের সব টাকাই বিমা দাবি পরিশোধে ব্যবহার করা হয়।

চিঠিতে বিশ্বজিৎ লিখেছেন, তিনি ২০২২ সালের ২৪ মে হোমল্যান্ড লাইফে যোগ দেওয়ার পর ৩৫ কোটি ৯ লাখ টাকা বিমা দাবি পরিশোধ করেছেন। এরমধ্যে আইডিআরএ’র নির্দেশনা থাকায় প্রথম ধাপে ১৩ কোটি টাকা স্থায়ী আমানত মেয়াদপূর্তিতে নগদায়ন ও ৪ কোটি টাকা পরবর্তী সময়ে বন্ড নগদায়নের মাধ্যমে ১৭ কোটি টাকা কোম্পানির তহবিল থেকে এবং অবশিষ্ট ১৮ কোটি টাকা নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে।

তিনি আরও লিখেছেন, কোম্পানিতে বর্তমানে বিমা দাবি পরিশোধ তহবিলে কোনো অর্থ নেই। পরিচালনা পর্ষদ থেকে বিমা দাবি পরিশোধ তহবিল পাওয়া গেলে আমরা দাবি পরিশোধ করতে পারবো। তহবিল ভেঙে বিমা দাবি পরিশোধে পরিচালনা পর্ষদ এতটা আগ্রহী নয়। পর্ষদ সদস্যরা নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে দাবি পরিশোধে তাগাদা দিচ্ছেন। কিন্তু আগে থেকেই নগন্য ব্যবসা থাকার কারণে নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ একেবারেই অপ্রতুল। তাই বিমা দাবি পরিশোধ এত কম এবং অনিষ্পন্ন বেশি হয়ে গেছে। এসব তথ্য উল্লেখ করে দাবি পরিশোধে পর্ষদকে তহবিল দেওয়ার নির্দেশনা দেয়ার জন্য আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আইডিআরএ থেকে হোমল্যান্ড লাইফের সিইওকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ২৪ মে থেকে এফডিআর, বিজিটিবি (সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ) নগদায়ন ও প্রিমিয়াম আয় থেকে ৩৫ কোটি ৯ লাখ টাকা যেসব বিমা গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়েছে, সেসব পলিসির বিস্তারিত তথ্য নির্ধারিত ছকে দিতে হবে। এ তথ্য দেওয়ার একটি ছকও তৈরি করে দিয়েছে আইডিআরএ। সেই সঙ্গে যেসব ব্যাংক হিসাবে বিমা গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করা হয়েছে, সেসব ব্যাংক হিসাবের বিবরণীও জমা দিতে বলা হয়েছে। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে বিজিটিবি বন্ড নগদায়ানের আবেদনটি বিবেচনা করা হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে হোমল্যান্ড লাইফের ২০২২ সালের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদেন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে কোম্পানিটি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করেছে ২৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০২১ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় হয় ৩৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০২২ সালে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয়েছে ৩০ কোটি ৩ লাখ টাকা, যা ২০২১ সালে ছিলো ৫৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির নতুন ও নবায়ন উভয় ধরনের প্রিমিয়াম আয় কমেছে।

আয় কমায় কোম্পানিটির লাইফ ফান্ডে নতুন কোনো অর্থ যোগ হচ্ছে না। উল্টো লাইফ ফান্ডের আকার কমছে। ২০২১ সাল শেষে লাইফ ফান্ড ছিল ২৪৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ২০২২ সাল শেষে তা দাঁড়িয়েছে ২১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকায়। অর্থাৎ লাইফ ফান্ড কমেছে ৩১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। আগের বছর ২০২১ সালে লাইফ ফান্ড কমে ১৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ২০২০ সালে লাইফ ফান্ড ছিল ২৬০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এদিকে কোম্পানিটির বিনিয়োগের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২ সাল শেষে সরকারি খাতে বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৮৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ২০২১ সালে এই বিনিয়োগ ছিল ৮১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ সরকারি খাতে বিনিয়োগ কমেছে ৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অন্যান্য খাতে ২০২১ সালে বিনিয়োগ ছিল ২২ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ২০২২ সাল শেষে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকায়।

যোগাযোগ করা হলে হোমল্যান্ড লাইফের সিইও ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল  বলেন, বর্তমানে আমাদের প্রায় ৭৯ কোটি টাকার মতো বিমা দাবি বকেয়া আছে। বিমা দাবি পরিশোধের জন্য কোনো নগদ তহবিল নেই। এ কারণে তহবিলের ব্যবস্থা করার জন্য আইডিআএ-কে চিঠি দিয়েছি। তিনি বলেন, প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় যা হয়, তার প্রায় পুরোটাই ব্যয় হয়ে যায়। আমাদের নবায়ন প্রিমিয়াম যা আদায় হচ্ছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধের চেষ্টা করছি। কিন্তু আগের বছরগুলোতে প্রথম বর্ষ ব্যবসা খুব একটা হয়নি। যে কারণে প্রতি মাসে ১ কোটি টাকার মতো নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় হচ্ছে। ওই টাকাই আমরা কোম্পানিতে নিয়ে না এসে, সংশ্লিষ্ট ব্রাঞ্চ থেকেই গ্রাহকদের দাবি পরিশোধে ব্যয় করছি। এখন বিজিটিবি বন্ড নগদায়ন করে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধের ব্যবস্থা করলে কিছুটা সুবিধা হয়। এতে হয়তো কোম্পানির সব সমস্যার সমাধান হবে না, তবে গ্রাহকরা দাবির টাকা পাবেন। তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন।

আইডিআরএ’র তথ্য চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি হোমল্যান্ড লাইফে যোগ দেওয়ার পর ৩৫ কোটি ৯ লাখ টাকার বিমা দাবি পরিশোধ করেছি। এ বিমা দাবি পরিশোধ সংক্রান্ত গ্রাহকদের তথ্য এবং ব্যাংক হিসাবের তথ্য আইডিআরএ থেকে চাওয়া হয়েছিল। আমরা গ্রাহকদের সব তথ্য এবং ব্যাংক হিসাব ও চেক নম্বরের তথ্য এরই মধ্যে আইডিআরএ’র কাছে জমা দিয়েছি। কিন্তু গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধের বিষয়ে তহবিলের কোনো ব্যবস্থা এখনো হয়নি।

আইডিআরএ’র মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম  বলেন, হোমল্যান্ড লাইফে গ্রাহকদের অনেক বিমা দাবি বকেয়া রয়েছে। দাবি পরিশোধে বিজিটিবি বন্ড নগদায়নের আবেদন করা হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদন দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। আমরা হোমল্যান্ডের কাছে তথ্য চেয়েছি। গ্রাহকের দাবির টাকা পরিশোধে আমরা হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে বসবো।