ঢাকা নগর পরিবহন মুখ থুবড়ে পড়ছে প্রথম রুট, আরও ৩ রুটে চালুর চিন্তা
কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত রুটটিতে এরই মধ্যে বাসের সংখ্যা ৫০ থেকে কমে নেমেছে ত্রিশে। এতে যাত্রীসেবার বদলে বেড়েছে দুর্ভোগ।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে বাস চালু করেছিল বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। কিন্তু উদ্বোধনের মাত্র সাত মাসের মাথায় মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে এই সেবা। রুটটিতে এরই মধ্যে বাসের সংখ্যা ৫০ থেকে কমে নেমেছে ত্রিশে। এতে যাত্রীসেবার বদলে বেড়েছে দুর্ভোগ।
যাত্রীদের অভিযোগ, এই রুটে ক্রমান্বয়ে বাসের সংখ্যা বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন উল্টো বাস কমছে। আগে যে বাসগুলো এই রুটে চলাচল করতো, সেগুলোর রুট পারমিটও বাতিল করা হয়েছে। ফলে যাত্রীর তুলনায় কমেছে বাসের সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে বাসের জন্য কাউন্টারে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। অনেকে বেশি ভাড়া দিয়ে বিকল্প পথে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এদিকে ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটের এই অবস্থার মধ্যেই আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন আরও তিনটি রুটে (২২, ২৩ ও ২৬ নম্বর) ঢাকা নগর পরিবহন চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। এতে এই কমিটির কার্যক্রম বা কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটের মতো এই তিনটি রুট মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে বলে মনে করছেন ঢাকার পরিবহন মালিকরা।
কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে রাজধানী হয়ে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর রুটের দূরত্ব ২১ কিলোমিটার। ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর এই পথে ৫০টি বাস নিয়ে চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহন। এর মধ্যে ৩০টি দ্বিতল বাস দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ও ২০টি বাস দিয়েছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সসিলভা। তখন বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, এই রুটে পর্যায়ক্রমে ১০০টি বাস নামবে। ২০২৩ সালের মধ্যে পুরো ঢাকায় এই সেবা চালু হবে।
ঘাটারচর থেকে বছিলা, মোহাম্মদপুর, শংকর, ঝিগাতলা, সায়েন্সল্যাব, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, মতিঝিল, হাটখোলা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, সানারপাড় হয়ে কাঁচপুর পর্যন্ত চলে নগর পরিবহন। সম্প্রতি এই এলাকাগুলো ঘুরে ঢাকা নগর পরিবহনের বাস তেমন একটা চোখে পড়েনি। অনেকক্ষণ পরপর বিআরটিসির দ্বিতল এক-দুটি বাস যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। অফিসের সময় ছাড়া দিনের অন্যান্য সময় প্রায় অর্ধেক আসনই থাকছে ফাঁকা। আর কাউন্টারগুলোতে যাত্রীদের চাপও কম। ট্রান্সসিলভার যে ২০টি বাস এই রুটে চলার কথা, সেগুলো দেখা যায়নি।
ধানমন্ডির ঝিগাতলা থেকে হাটখোলা নিয়মিত যাতায়াত করেন বেসরকারি চাকরিজীবী তাজুল ইসলাম। গত মঙ্গলবার (২০ জুলাই) সকালে নগর পরিবহনের বাসে তিনি অফিসে যান। আলাপকালে বলেন, আগে এই রুটে রজনীগন্ধা, সিটি লিংকের কয়েকশ (১৬১টি) বাস যাত্রী পরিবহন করতো। ঢাকা নগর পরিবহন চালু হওয়ার পর ওই বাসগুলোর রুট পারমিট বাতিল করা হয়। তখন নগর পরিবহনের বাসে যাত্রী বাড়ে। বাসগুলো নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে যাত্রী নেওয়ায় কারও কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু এখন রুটে বাস কমে যাওয়ায় যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। অফিস সময়ে ঠিকমতো বাস পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অন্য পরিবহনের কোনো বাস এই রুটে চলাচল করতেও দেওয়া হচ্ছে না।
সাত মাসের মাথায় ঢাকা নগর পরিবহনের দুরবস্থায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মাহতাব উদ্দিন নামে এক যাত্রী। তিনি বলেন, এই বাসগুলো চালুর পর এই রুটে শৃঙ্খলা এসেছিল। কাউকে বাসে দৌড়-ঝাঁপ করে উঠতে হতো না। কোনো বাসের সঙ্গে চালকের প্রতিযোগিতা ছিল না। যাত্রা অনেকটা নিরাপদ ছিল। এখন বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির তদারকির অভাবে এমন বিশৃঙ্খলা ঘটেছে।অন্যদিকে বাস সংকটের কারণে সেবা দেওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন এই পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
কাঁচপুর যাত্রী ছাউনিতে দায়িত্বরত টিকিট বিক্রেতা জামান হোসেন বলেন, গত জুনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বেসরকারি পরিবহনের বাসগুলো যাত্রী পরিবহন করেছিল। কিন্তু এরপর লোকসানের অজুহাতে ক্রমান্বয়ে তারা বাস সরিয়ে নেয়। অথচ এই রুটে প্রচুর যাত্রী রয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকা নগর পরিবহন যে গতিতে কাজ শুরু করেছিল, এখন বাস সংকটে তা অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। ঠিকমতো যাত্রীদের সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কাউন্টারে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর বাস না পেয়ে চলে যাচ্ছেন যাত্রীরা। এই সুযোগে অন্যান্য বাস এই রুটের যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে।
একই রকম কথা বলেন বিআরটিসির চালক আমান উল্লাহ। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত বাস না থাকায় প্রায়ই যাত্রীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়। অথচ ঢাকা নগর পরিবহন চালু হওয়ার পর তা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১৫ সালে বাস রুট রেশনালাইজেশন বা রুটভিত্তিক কোম্পানির অধীনে বাস সেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তখন তিনি বলেছিলেন, ঢাকার পুরোনো ও জরাজীর্ণ বাসগুলো সরিয়ে চার হাজার নতুন বাস নামানো হবে। একটি রুট একটি কোম্পানির অধীনে চালানো হলে বাসে বাসে প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে। এতে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে, শৃঙ্খলা ফিরবে। অথচ অব্যবস্থাপনায় প্রথম চালু হওয়া রুটটিই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটে বাস চালুর বিষয়ে জানতে চাইলে ডিটিসিএ’র নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার বলেন, বিআরটিসির বিদ্যমান বাসগুলো দিয়েই এই রুটে যাত্রী চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে। তারপরও এর সঙ্গে নতুন আরও কিছু বাস যুক্ত করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু আগের ২০টি বাস রুট ছেড়ে কেন চলে গেছে, তার কোনো উত্তর দেননি তিনি।
তবে ডিটিসিএ’র ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম শনিবার (২৩ জুলাই) বলেন, ট্রান্সসিলভার সঙ্গে ছয় মাসের চুক্তি ছিল। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় তারা বাসাগুলো উঠিয়ে নেয়। এখন নতুন করে আবার ট্রান্সসিলভার বাস ওই রুটে যুক্ত হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে ১৫টি বাস যাত্রী পরিবহন করেছে বলে দাবি করেন তিনি।
এর আগে গত ২১ জুন ঢাকা দক্ষিণ সিটির নগর ভবনে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ২৩তম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটে বাস কমে যাওয়ার বিষয়ে এক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ঢাকা নগর পরিবহন ঢাকাবাসীর কাছে সমাদৃত হয়েছে। একটি দুটি বাস কমলো বা বাড়লো-সেটা কিন্তু সাফল্যের নির্ণায়ক নয়। সফলতার বিষয় হচ্ছে- এই পথটি এখনো চালু রয়েছে।
তিনি বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ট্রান্সসিলভা তাদের বাসগুলো সরিয়ে নিয়েছে। তারা নতুন আরও ২০টি বাস চালুর আবেদন করেছিল। কিন্তু আমরা তাদের নতুন করে আর অনুমোদন দেবো না। জাহান এন্টারপ্রাইজ ২০টি বাস চালুর আবেদন করেছিল এবং সেগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছে। সেই বাসগুলো এই পথে আমরা চালু করবো।
ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটের সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব পাশ কাটিয়ে নতুন আরও তিনটি রুটে ঢাকা নগর পরিবহন চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে এই তিনটি রুটে (২২, ২৩ ও ২৬ নম্বর) ২০০টি নতুন বাস চালুর প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে ২২ নম্বর রুট যাবে ঘাটারচর থেকে ওয়াশপুর-বসিলা-মোহাম্মদপুর টাউন হল-আসাদ গেট-ফার্মগেট-কাওরানবাজার-শাহবাগ-কাকরাইল-ফকিরাপুল-মতিঝিল-টিকাটুলি-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-কোনাপাড়া হয়ে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত।
২৩ নম্বর রুটে ঘাটারচর থেকে ওয়াশপুর-বসিলা-মোহাম্মদপুর-জাপান গার্ডেন সিটি-শ্যামলী-কলেজ গেট-আসাদ গেট-কলাবাগান-সায়েন্স ল্যাব-শাহবাগ-মৎস্য ভবন-প্রেস ক্লাব-গুলিস্তান (জিরো পয়েন্ট)-দৈনিক বাংলা-রাজারবাগ-কমলাপুর-ধলপুর-যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া-রায়েরবাগ-মাতুয়াইল-সাইনবোর্ড হয়ে চিটাগং রোড যাওয়া যাবে।
এছাড়া ২৬ নম্বর রুটে ঘাটারচর থেকে ওয়াশপুর-বসিলা-মোহাম্মদপুর-টাউন হল-আসাদ গেট-কলাবাগান-সায়েন্স ল্যাব-নিউমার্কেট-আজিমপুর-পলাশী- চাঁনখারপুল-ফ্লাইওভার হয়ে পোস্তগোলা ও কদমতলী বাস চলাচল করবে।
ডিটিসিএ সূত্র জানায়, গত ২১ জুন দক্ষিণ সিটির নগর ভবনে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভায় এই রুটগুলোতে ঢাকা নগর পরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে এই তিনটি পথে ঢাকা নগর পরিবহন চালু করার জন্য বাস চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তিনটি রুটেই আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ২২ নম্বর যাত্রাপথে অভি মোটরস ২০২২ সালে নির্মিত ৫০টি বাস চালুর প্রস্তাব করেছে। একইভাবে ২৩ নম্বর যাত্রাপথে হানিফ এন্টারপ্রাইজ ২০২২ সালে নতুন নির্মিত ১০০টি বাস চালুর আবেদন করেছে। ২৬ নম্বর যাত্রাপথে ৫০টি ডাবল ডেকার বাস চালুর আবেদন করেছে বিআরটিসি। এখন আবেদনগুলো যাচাই-বাছাইসহ অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলছে। তবে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির এই উদ্যোগ সফল হবে না বলে মনে করছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির একাধিক নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন মালিক বলেন, যে তিনটি রুটে ঢাকা নগর পরিবহন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এখন সেই রুটে বিভিন্ন কোম্পানির হাজারো বাস যাত্রী পরিবহন করে। ঢাকা নগর পরিবহন চালু হলে এই বাসগুলোর রুট পারমিট বাতিল করার কথা বলা হচ্ছে। এমনটা হলে সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ডিটিসিএ’র নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews