ডলার সংকটে আমদানি কমেছে দাম আরও বাড়ার শঙ্কা
বাংলাদেশ ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ডলার সংকট চলতি অর্থবছরেও চলমান থাকবে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন : ডলার সংকটের কারণে গত বছর কেবলমাত্র খাদ্য, জ্বালানি, কৃষি, শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ আমদানি ছাড়া বাকি সব পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সরকার, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এতে পণ্য ভেদে আমদানি কমেছে প্রায় ১৫ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। আমদানি কমায় বাজারে এসব নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। দেশে ডলারের সংকট সমাধান অনিশ্চিত হওয়ায় পণ্য মূল্য আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ডলার সংকট চলতি অর্থবছরেও চলমান থাকবে।
জানা গেছে, গত বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ওই সময় থেকেই দেশে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বেড়ে যায় জ্বালানি তেলসহ প্রায় সব পণ্যের দাম। গত বছরের এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিতে ২৫ শতাংশ এলসি মার্জিন আরোপ করে। পরে ধাপে ধাপে তা বাড়িয়ে শতভাগ করা হয়। আমদানিতে এই কড়াকড়ি আরোপ এখনো চলমান রয়েছে।
তবে গত সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের সংস্থান ছাড়া কোনো এলসি খোলা যাচ্ছে না। ফলে এখন কেবলমাত্র যাদের ডলার আয় আছে যেমন- রপ্তানিকারক, কেবল তারাই এলসি খুলতে পারছেন। এর বাইরে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের কিছু বাড়তি ডলার দিয়ে সরকারি খাত ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক খাতে কোনো পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। এর ফলে রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ ভেসেল বা পুরোনো জাহাজ ৬১ শতাংশ, আয়রন ও স্টিল স্ক্র্যাপ ২০ শতাংশ, বিভিন্ন ধরনের মেটাল ৭১ শতাংশ, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল ১৪ শতাংশ, কটন ইয়ার্ন ৪০ শতাংশ আমদানি কমেছে। এমনকি রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও ১৬ শতাংশ কমেছে, এলসি খোলা কমেছে ৩৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডলার সংকটে চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলে ভোগ্যপণ্যের আমদানি ১২ শতাংশ ও এলসি খোলা কমেছে ১৮ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালের এলসি ৩১ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ২৪ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি ৩২ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ১০ শতাংশ। শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি ৫৭ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ১৭ শতাংশ। বিবিধ শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি কমেছে ৪৬ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ৩২ শতাংশ। অন্যান্য পণ্যের এলসি ২০ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ১ শতাংশের বেশি। তবে জ্বালানি তেল ও জ্বালানি খাতের উপকরণ আমদানির এলসি বেড়েছে আড়াই শতাংশ ও আমদানি বেড়েছে ১৬ শতাংশ। এর প্রভাবে শিল্প খাতে নেতিবাচক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
সংকটের কারণে গত বছরের এপ্রিল থেকে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। ২০২২ সালে এক ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা। এখন তা বেড়ে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা ছাড়িয়ে গেছে। দাম বেড়েছে ২৫ টাকা ৫০ পয়সা। বৃদ্ধির হার ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ দেড় বছরে টাকার মান কমেছে ৩০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ব্যয় কমিয়ে ডলার সংকট মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। তবে সরকার এখনো বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে পারেনি। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমানোর সহজ পথ বেছে নিয়েছে তারা। এতে উল্টো ফলাফল দেখা দিয়েছে। আমদানিনির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। এতে উৎপাদন কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাতের প্রবৃদ্ধি খুবই কম। ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঘাটতি হচ্ছে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও টান পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি কমলেও বকেয়া আমদানির দেনা ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ মিলে প্রতি মাসে যে ডলারের সংস্থান হওয়া দরকার তা হচ্ছে না। বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে ৭০০ কোটি ডলারের আয় হচ্ছে। এর বিপরীতে তাৎক্ষণিক আমদানির দেনা মেটাতে যাচ্ছে ৬৫০ কোটি ডলার। বকেয়া ঋণ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে আরও কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার। এ হিসাবে মাসে ঘাটতি ৫০ কোটি ডলার। এ ছাড়া বিদেশে বিভিন্ন সেবা, রয়্যালটি, মুনাফা প্রত্যাবাসনসহ সবমিলে আরও বাড়তি খরচ হচ্ছে। এতে প্রতি মাসে ডলারের ঘাটতি হচ্ছে।
এদিকে আগে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে স্বল্পমেয়াদি দায় মেটানো হতো। এখন ঋণ গ্রহণের পরিমাণ কমে গেছে। যে কারণে এখন ডলার সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। এরমধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ মান কমিয়ে দেয়ার পূর্বাভাস দেয়ায় বিদেশ থেকে ঋণপ্রবাহ আরও কমবে। একই সঙ্গে বাড়বে খরচ। এতে ডলারের সংকট আরও প্রকট হতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানায়, ডলারের সংকট ধীরে ধীরে কমছে।