ঠাটারি বাজার: ইজারাদারের টাকা-কাউন্সিলরের ‘চাঁদা’য় দিশেহারা ব্যবসায়ীরা

পুরান ঢাকার ঠাটারি বাজারের স্থাপনাটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সব সময় আতঙ্কে থাকতেন দোকানিরা। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেড় বছর আগে স্থাপনাটি ভেঙে ফেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। নতুন ভবন নির্মাণ নিয়ে জটিলতা কাটেনি এখনো। পরে উন্মুক্ত সেই স্থানে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়ে প্রতিদিন চাঁদা তোলা শুরু করেন বলে অভিযোগ ডিএসসিসির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে।

ঠাটারি বাজার: ইজারাদারের টাকা-কাউন্সিলরের ‘চাঁদা’য় দিশেহারা ব্যবসায়ীরা
ঠাটারি বাজার

প্রথম নিউজ, ঢাকা: পুরান ঢাকার ঠাটারি বাজারের স্থাপনাটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সব সময় আতঙ্কে থাকতেন দোকানিরা। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেড় বছর আগে স্থাপনাটি ভেঙে ফেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। নতুন ভবন নির্মাণ নিয়ে জটিলতা কাটেনি এখনো। পরে উন্মুক্ত সেই স্থানে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়ে প্রতিদিন চাঁদা তোলা শুরু করেন বলে অভিযোগ ডিএসসিসির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি জায়গাটি ইজারা দিয়েছে ডিএসসিসি। এখন ইজারাদারকে প্রতিদিন দিতে হচ্ছে টাকা। আবার চাচাতো ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচালনা করা চাঁদা অর্ধেকে নামালেও বন্ধ করেননি কাউন্সিলর। ইজারাদার ও কাউন্সিলরের চাপে দিশেহারা বাজারটির দোকানিরা।

ঠাটারি বাজারের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এখন ইজারাদার ও ডিএসসিসির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফীর লোকজন সমানভাবে চাঁদা চাইছেন। অথচ তারা নিয়ম মেনে ডিএসসিসির কাছ থেকে ঠাটারি বাজারে দোকানের বরাদ্দ নিয়েছিলেন। তাদেরই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে করপোরেশন ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙেছিল। এখন ডিএসসিসি তাদের জন্য একই জায়গায় নতুন ভবন তৈরি না করে ইজারা দেওয়ায় এমন জটিলতা তৈরি হয়েছে।

তবে দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্পত্তি বিভাগ থেকে তারা এখনো জমি বুঝে পাননি। তাই ভবন নির্মাণের প্রাথমিক কাজই তারা শুরু করতে পারছেন না। তবে ভিন্ন কথা বলেছেন সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, অনুমোদনের জন্য অনেক আগেই ফাইল ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখনো অনুমোদন মেলেনি।

ভবনটি ভাঙার দেড় বছর পরও নতুন ভবন নির্মাণে অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে ভিন্ন কারণ দেখছেন ঠাটারি বাজার মৎস্য কাঁচামাল সবজি বিক্রেতা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির নেতারা। সংগঠনটির সাবেক সহ-সভাপতি খায়রুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নতুন ভবন হলে কাউন্সিলরের দৈনিক চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। তাই স্থানীয় কাউন্সিলর নতুন ভবন নির্মাণের দরপত্র আটকে রেখেছেন। সিটি করপোরেশনের এই দুই বিভাগও গাছাড়া দিয়ে আছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন ডিএসসিসির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী। তিনি জাগো নিউজকে জানান, একটি চক্র তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। চাঁদাবাজির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এখন যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে মার্কেটের জায়গা ইজারা দেওয়া হয়েছে, তারাই টাকা তুলছে।

ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে ঠাটারি বাজারে একতলা একটি ভবন নির্মাণ করে ১৯৯ ব্যক্তিকে অস্থায়ী বরাদ্দ দিয়েছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। পরে ২০১৮ সালে তার ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন এসব ব্যক্তিকে চূড়ান্ত বরাদ্দপত্র দেন। দোকানপ্রতি মাসে ৮শ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।

ঠাটারি বাজারের দোকানিরা জানান, চূড়ান্ত বরাদ্দের পর ঠিকমতোই তারা সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন সময় ভবনের পলেস্তারা খসে পড়তো। অনেক দোকানি ও ক্রেতা এতে আহত হয়েছেন। বৃষ্টি হলে ছাদ থেকে গড়িয়ে পানি দোকানে ঢুকতো। এমন পরিস্থিতিতে তারা মার্কেটটি ভাঙার দাবি জানিয়েছিলেন। সিটি করপোরেশন ভবনটি ভাঙার পর ফাঁকা জায়গায় ব্যবসা করার সুযোগ দিতে কাউন্সিলরকে অনুরোধ করেন দোকানিরা। তখন স্থানীয় কাউন্সিলর ব্যবসা করতে হলে রাজস্ব দিতে হবে জানিয়ে বিষয়টি নিয়ে তার চাচাতো ভাই ইয়াছিরের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

পরে ইয়াসির দোকানিদের জানান, ব্যবসা করতে হলে দিনে দোকানপ্রতি ২শ টাকা করে দিতে হবে। নিরুপায় হয়ে ১৯৯ দোকানি কাউন্সিলরকে দিনে ৩৫ হাজার টাকা দিতে রাজি হন। এভাবে তারা গত দেড় বছরে ইয়াসিরকে প্রায় এক কোটির বেশি টাকা দিয়েছেন বলে দাবি তাদের। গত ২৮ সেপ্টেম্বর এই চাঁদাবাজি নিয়ে ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বরাবর আবেদন দেন ঠাটারি বাজারের দোকানিরা। লিখিত এই আবেদনে বলা হয়, ১৯৯৬ সাল থেকে তারা সিটি করপোরেশনকে নিয়মিত ভাড়া দিচ্ছেন। ভবন ভেঙে ফেলার পর সিটি করপোরেশন ভাড়া নিচ্ছে না। অথচ দোকানিদের জিম্মি করে স্থানীয় কাউন্সিলরের চাচাতো ভাই ইয়াছির প্রতিদিন টাকা আদায় করছেন।

এমন অভিযোগের পর এই জায়গা ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ নেয় ডিএসসিসি। পরে অক্টোবরে এই বাজারের জায়গা ইজারা নেন মো. কামরুজ্জামান নামে এক ব্যক্তি। এখন তিনিও প্রতিদিন ২৭০ টাকা করে আদায় করতে চাইছেন। কিন্তু দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। পরে গত ২৮ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে ইজারাদার কামরুজ্জামান ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের লোকজন কয়েকজন দোকানির ওপর হামলা চালান। কয়েকটি দোকানও ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ। প্রতিবাদে গত ১ ও ২ ডিসেম্বর ঠাটারি বাজারের সব দোকান বন্ধ রাখেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তারপরও কাউন্সিলরের লোকজনের চাঁদা ওঠানো বন্ধ হয়নি। এখনো দিনে ১শ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ইজারাদার নিয়মিত টাকা তুলছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে ইজারাদার মো. কামরুজ্জামান জানান, তিনি সিটি করপোরেশন থেকে যথাযথ নিয়মেই ঠাটারি বাজারের জায়গা বরাদ্দ নিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা নিয়মিত টাকাও দিচ্ছেন। কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে এসময় তিনি হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেন। বৃহস্পতিবার (৮ ডিসেম্বর) সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙা ভবনের জায়গায় ত্রিপল টাঙিয়ে দোকান পরিচালনা করছেন ব্যবসায়ীরা। বাজারে মূলত মাছ ও শাকসবজি বিক্রি করা হয়। ক্রেতাদেরও প্রচুর ভিড় দেখা গেছে।

সবজি দোকানি সারোয়ার জানান, টানা দুদিন দোকানপাট বন্ধ থাকার পর কাউন্সিলরের লোকজন তাদের নিয়ে বসেছিলেন। আগে যেখানে ২শ টাকা দিনে চাঁদা নেওয়া হতো এখন ১শ টাকা করে নিচ্ছে। এই টাকা একেক সময় একেক দোকানির মাধ্যমে কাউন্সিলরের চাচাতো ভাই ইয়াসিরের কাছে যায়।

ঠাটারি বাজারের জায়গা ইজারা দেওয়া এবং দোকানিদের কাছ থেকে স্থানীয় কাউন্সিলরের চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরীন বলেন, ঠাটারি বাজারের এই জায়গাটি দীর্ঘদিন খালি পড়ে ছিল। তাই ইজারা দিয়ে রাজস্ব আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি ইজারা পেয়েছেন, তাকে জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন ভবন হলে চূড়ান্ত বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা দোকান বুঝে পাবেন। কাউন্সিলরের লোকজনের টাকা আদায়ের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom