টিকিট কাটা-চিকিৎসকের সিরিয়ালে সময় পার, সেবায় সন্তোষ
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল
প্রথম নিউজ, ঢাকা: ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল পরিচ্ছন্নতা ও সেবার দিক থেকে বেশ এগিয়ে। ২০১২ সালে কার্যক্রম শুরু করা হাসপাতালটিতে মেলে অধিকাংশ চিকিৎসাসেবা। রোগী দেখা হয় আউটডোর ও জরুরি বিভাগে। রয়েছে কোভিড-১৯ সহ প্রায় সব ধরনের টিকা কার্যক্রম। তবে যে সেবাই নিতে চান তার জন্য আগে কাটতে হবে ১০ টাকার টিকিট। সেখানে দাঁড়াতে হয় দীর্ঘ লাইনে। রোগীদের বসার জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। টিকিট কাটার পর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের দেখা পেতেও সিরিয়ালে বসে থাকতে হয় দীর্ঘক্ষণ।
হাসপাতালের দেওয়া তথ্যমতে, এখানে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচ শতাধিক রোগী ভর্তি হয়। আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসেন পাঁচ হাজারের অধিক রোগী। ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিসে চিকিৎসা নেন আরও চার থেকে পাঁচশ রোগী।
সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বাহ্যিক পরিবেশ বেশ সুন্দর-গোছালো। হাসপাতালের মূল ভবনের ডান দিকে সরকারি বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণের রুম। সেখানে দীর্ঘ লাইন ধরেই মানুষ ওষুধ নিচ্ছেন। ভবনের ভিতরে বাঁ পাশে লাইন ধরে আউটডোরের টিকিট কাটছেন নারীরা। পুরুষরা সিরিয়াল নিতে দাঁড়িয়েছেন বেজমেন্টে। সেখান থেকে টিকিট নিয়ে নির্দিষ্ট কক্ষে রোগীরা যাচ্ছেন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে।
এছাড়া হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিসে জরুরি রোগীদের চিকিৎসা ও সাধারণ রোগীদের ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে যেসব রোগী স্বল্প সময়ে চিকিৎসা নিয়ে চলে যাবেন তাদের সেবা দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় থাকলেও চোখে পড়েনি কোনো দালালের দৌরাত্ম্য। হাসপাতালের কর্মচারীরাই রোগীদের নানান পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তবে যত নিয়মই মেনে চলা হোক, অতিরিক্ত রোগীর চাপে সেবা দিতে কিছুটা বেগ পেতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। রোগীদেরও অপেক্ষা করতে হয় লাইন ধরে।
আউটডোরে মেডিসিন বিভাগে মাকে নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এসেছেন টঙ্গীর সাইদুর রহমান। পথে আসতে দেরি হওয়ায় সিরিয়ালও পেতে দেরি হয়। আর এতে দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাদের। টিকিট কেটে চিকিৎসকের কক্ষে প্রবেশের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়েছে দুই ঘণ্টা।
হাসপাতালের নিচতলার মেঝেতে শুয়ে আছেন মধ্যবয়সী নারী সাজিয়া। সঙ্গে তার মা ছিলেন। ভাই গেছেন গাড়ি ঠিক করতে। সাজিয়ার ভাই জানান, তার বোনের কোমরের ব্যথা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। চিকিৎসককে দেখানোর পর পরীক্ষা দেন। এই মুহূর্তে ভর্তি করাতে চাইলে ভর্তি নিচ্ছে না। বলেছেন পরীক্ষার রেজাল্টের পর ভর্তি করাবে কি না দেখবে।
হাসপাতালের নিচ তলায় নেই কোনো বসার আসন। এতে রোগীর সঙ্গে আসা সদস্যরা টিকিট কিনতে লাইনে দাঁড়ালেও রোগীদের নিচে মেঝেতে শুয়ে-বসে অপেক্ষা করতে হয়। বেশি অসুস্থ রোগীদের জন্য যা বেশ কষ্টকর। টিকিট কাটার পর দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে সুযোগ মিলছে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার। এরপর যে কোনো টেস্টের জন্য আগে টাকা জমা দিতে হয়। টাকা জমা দেওয়ার পর আবার লাইনে দাঁড়িয়ে তবেই এক্সরে, রক্ত বা অন্য কোনো টেস্ট করানো যায়। অধিকাংশ টেস্টের রেজাল্ট আসে পরের দিন। ফলে রোগীদের পরের দিন টেস্টের রেজাল্টসহ টিকিট কেটে সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিতে হয় সেবা। অনেক সময় দায়িত্বরতা খারাপ ব্যবহার করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধ পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন অধিকাংশ রোগী। দায়িত্বরতরা বলেন, ঈদের কারণে এখনো চিকিৎসক কম থাকায় কিছুটা চাপ বেড়েছে।
বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ
হাসপাতালের ওষুধ বিতরণ ব্যবস্থা অন্য সরকারি হাসপাতালের তুলনায় ভালো। এই হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ থাকায় রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দিতে সমস্যা হচ্ছে না বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের প্রায় শতভাগ ওষুধই বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এই হাসপাতালের আশপাশে থাকা বিদেশি লোকজনও সেবা নিতে যান।
আউটডোর সার্ভিস
হাসপাতালের আউটডোরে নিয়ম-শৃঙ্খলার সঙ্গে লাইন ধরেই টিকিট নিয়ে চিকিৎসা নিতে হয় রোগীদের। টিকিট সংগ্রহের পর নির্দিষ্ট কক্ষে সেবা নিতে আবারও অপেক্ষা করতে হয় রোগীদের। প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি রোগী এখানে আউটডোরে চিকিৎসা নেন। মেডিসিন, পেডিয়াট্রিক, স্কিন ডিজিস, অর্থোপেডিকসহ প্রায় ১৭ বিভাগের চিকিৎসা এখানে দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা ৩০ পর্যন্ত আউটডোরে রোগী দেখা হয়। হাসপাতালের তথ্যমতে, আউটডোরে বেশি রোগী দেখার ক্ষেত্রে ঢাকায় তৃতীয় স্থানে আছেন তারা।
রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা
সরকারি হাসপাতালগুলোতে গেলেই মেশিন নষ্ট, দালালের দৌরাত্ম্য, কর্মচারীর অভাবসহ নানান কারণে ডায়াগনস্টিক সেবা ব্যাহত হয়। তবে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় সাবলীলভাবে। রোগীদের ৯৫ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষাই এখানে করা হয়। কিছু বিশেষায়িত পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে যেগুলো এই হাসপাতালে হয় না। সেগুলো অন্য হাসপাতাল থেকে করে আনতে হয়। সরকারের নির্ধারিত মূল্যে এক্সরে, ইসিজিসহ ৭৩ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানে দেওয়া হয়।
ক্যান্টিন সেবা
হাসপাতালের ক্যান্টিনের খাবারের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই। ফলে দাম ও মান অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকে। হাসপাতালের রোগী ও রোগীর সঙ্গে আসা লোকজন এখানে খাবার খেতে পারে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, হাসপাতালের পরিচালক থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারী সবাই নিয়ম মেনে কাজ করেন। এতে এই হাসপাতালে আসা রোগীরা সেবা পান। আমি মনে করি সব হাসপাতালের দায়িত্বরতরা দায়িত্বশীলভাবে কাজ করলে সেবার মান আরও অনেক বাড়বে।
‘আমাদের কোনো বিশেষ বন্ধের আগেই চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনার মাধ্যমে আমরা শিফট আকারে কারা থাকবে না থাকবে তা ঠিক করে দেই। এতে আমাদের সমস্যা কম হয়। তবে ঈদের বন্ধের সময় চিকিৎসক কম থাকলেও রোগীর চাপ অনেক বেশিই ছিল। এতে অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। তিনি বলেন, আমি পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে হাসপাতালের কার্যক্রমের সুনাম অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছি। আমার চেষ্টা এই হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশন করা। এটি করতে পারলে আমাদের এখানে বিশ্বমানের সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি
হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ড ও নারী ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি মা তাসনিম ও মেয়ে তানহা। তারা বনানী এলাকার বাসিন্দা। চারদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। এখানকার বেশিরভাগ ডেঙ্গুরোগী বসুন্ধরা ও বনানী এলাকার বাসিন্দা। বসুন্ধরার ডি ব্লকের বাসিন্দা তাবাসসুম। ১৪ বছর বয়স তার। ঈদের পরদিন থেকে জ্বরে ভুগছিলেন। হাসপাতালে এলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এই হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা অন্য হাসপাতালের তুলনায় এখনো কম। মঙ্গলবার (৪ জুলাই) ভর্তি ছিল ২১ জন ডেঙ্গুরোগী। এর মধ্যে ১৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও তিনজন শিশু। হাসপাতালের ডেঙ্গুরোগীদের দায়িত্বে ছিলেন ডা. হাসিব।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালে দুজন কিছুটা কম্প্লিকেশন নিয়ে এলেও বেশিরভাগ রোগী খারাপ অবস্থায় আসেনি। এখনো আমাদের এখানে কারও মৃত্যু হয়নি। তবে অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রোগীর সংখ্যা বাড়বে। এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক বলেন, আমাদের রোগী বাড়লে আসন বাড়াতে পারবো। প্রয়োজনে অন্য রোগীদের জন্য আসন বরাদ্দ কমিয়ে ডেঙ্গুরোগীদের সেবার ব্যবস্থা করবো। এখানে দুই থেকে আড়াইশ ডেঙ্গুরোগী ভর্তি করানো সম্ভব।