জীবন হাতে নিয়ে চিকিৎসাসেবা চলছে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে
কয়েক জায়গায় লোহার খুঁটির ঠেস দিয়ে তিনতলা ভবনকে ভাঙন থেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
প্রথম নিউজ, শরীয়তপুর: কিছুদিন পর পর ভেঙে পড়ছে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা। কয়েক জায়গায় লোহার খুঁটির ঠেস দিয়ে তিনতলা ভবনকে ভাঙন থেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের পাশাপাশি সিভিল সার্জনের অফিসটিও ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এমন তথ্য জানিয়েছেন শরীয়তপুর গণর্পূত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মহিবুর রহমান পিইঞ্জ।
হাসপাতালের এই চিত্র কয়েক বছরের পুরোনো হলেও নতুন ভবনের কাজে গতি নেই। দ্বিতীয় দফায় নতুন ভবন নির্মাণের মেয়াদ বাড়ানো হলেও কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৬৫ শতাংশ। সর্বশেষ মঙ্গলবার (০৪ জুলাই) হাসপাতালের স্টোর রুমের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে। এই কক্ষে সেবা দেন হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট বিকাশ কুমার সরকার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সকালে রুমের তালা খুলে দেখি ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে আছে। যদি আমরা রুমে থাকতাম, তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। ছাদ ও দেয়াল থেকে পলেস্তারা মাঝে মধ্যেই খসে পড়ে। জীবন-জীবিকা তাগিদে আমরা অফিস করি।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতাল ভবনের নিচতলার করিডোর, বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টার, ডায়রিয়া ওয়ার্ডে যাওয়ার করিডোর, এক্স-রে কক্ষ ও অফিস কক্ষে বসানো হয়েছে লোহার খুঁটি। এছাড়াও হাসপাতালের কমপক্ষে ১০ স্থানে পলেস্তারা খসে পড়েছে। গণপূর্ত বিভাগ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পরও ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রেখেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসক, কর্মচারী ও রোগীরা মাথায় ছাদের পলেস্তারা ভেঙে পড়ার আতঙ্কে রয়েছেন সব সময়।
জানা যায়, গত পাঁচ বছরে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের ছাদ থেকে কমপক্ষে ৭ বার পলেস্তারা খসে পড়ে রোগীরা আহত হয়েছেন। ১৯৮৫ সালে গণপূর্ত বিভাগ শরীয়তপুরের চৌরঙ্গী এলাকায় শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে। এরপর ২০০৩ সালে হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলে ২০০৬-২০০৭ অর্থ বছরে তৎকালীন সংসদ সদস্য হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ওই দ্বিতল ভবনের ওপর তৃতীয়তলা নির্মাণ করে ২০০৯ সালে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দেয়। ভিত্তিপ্রস্থর ছাড়া তিনতলা ভবন নির্মাণ করা হলে হাসপাতাল ভবনের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।
হাসপাতাল ভবন বুঝিয়ে দেয়ার ৯ বছরের মাথায় ২০১৮ সালে ভবনটির নিচতলার পূর্বদিকে বর্হিবিভাগের চিকিৎসকদের কক্ষের সামনের দিকের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ায় তিন রোগী আহত হয়। এরপর কয়েক দফায় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কক্ষ, টিকিট কাউন্টারের সামনের ছাদ, সিঁড়ির দিকের ছাদ থেকে পলেস্তারা ভেঙে পড়ে। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গণপূর্ত বিভাগকে চিঠি দিলে ২০২১ সালের ২৮ জুলাই গণপূর্ত বিভাগের বিশেষজ্ঞ টিম হাসপাতাল ভবন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করে ভবনটির কাঠামোগত নকশা পায়নি। বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্য ও গণপূর্ত বিভাগের ডিজাইন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী লিন্টু গাজী প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ভবনটির নিচতলার বিভিন্ন স্থানে পলেস্তারা ও কভার খুলে গেছে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
২০২০ সালে এক্স-রে বিভাগের একটি কক্ষের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে। পলেস্তারা খসে পড়া ঠেকাতে ওই কক্ষের ভেতরে আটটি লোহার খুঁটি লাগানো হয়। এক্স-রে বিভাগের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাথায় পলেস্তারা খসে পড়ার আতঙ্ক নিয়ে দায়িত্ব পালন করছি। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে না দেখলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। নিরালা এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন বিকাশ মন্ডল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে দেখছি, হাসপাতাল ভবনটি নিজেই অসুস্থ। হাসপাতালের ভেতর ও বাইরে যারা অবস্থান করছেন, তারা যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে ফিরতে পারলে বাঁচি।
শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার সুমন কুমার পোদ্দার বলেন, সদর হাসপাতাল শরীয়তপুরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রাণ কেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৬০০-৭০০ ও আন্তঃবিভাগে ২০০-২৫০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকে। হাসপাতালটি দ্বিতল ভবনের হলেও এটাকে তিনতলায় রূপান্তর করা হয়েছে। আজ পর্যন্ত ৮-১০ বার ভবনের দেয়ালসহ ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল রাতেও ফার্মাসিস্ট কক্ষের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন হাসপাতালের কার্যক্রম অন্য জায়গায় করা হোক কিংবা নতুন ভবনের কাজ দ্রুত শেষ করে সেখানে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। আমরা সব সময় আতঙ্কের মধ্যে আছি।