জাতীয় নির্বাচন কবে ধোঁয়াশা থাকছেই

জাতীয় নির্বাচন কবে ধোঁয়াশা থাকছেই

প্রথম নিউজ, অনলাইন:  জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হতে পারে সে বিষয়ে একটি সম্ভাব্য ধারণা দিলেও দিনক্ষণ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে নির্বাচন চলতি ২০২৫ সালেই না কি আরো দেরি হবে তা কারো কাছেই স্পষ্ট নয়।

খ্রিস্টীয় বছরের শুরুতেও নির্বাচন কবে হবে—সেটাই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। নতুন বছরের শুরুতে নির্বাচনের রোডম্যাপ পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো।
জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হলে এই বছর নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করে বিভিন্ন মহল।

বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলও নতুন বছরেই নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে দাবি তুলেছে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির বক্তব্যে মনে হচ্ছে, তারা নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে আরো সময় দিতে চায়। ছাত্রদের এই দাবির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্যে অনেকাংশে মিল পাওয়া যায় বলে মনে করছেন অনেকে।

গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর কয়েকজন উপদেষ্টা ২০২৫ সালে নির্বাচন হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন। কোনো কোনো উপদেষ্টা আবার সংস্কার শেষ করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দিয়েছেন। সরকারের মধ্যে দুই ধরনের বক্তব্যেও নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। 

গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের প্রথম দিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
পরে এর ব্যাখ্যা দেয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। তাতে নির্বাচনটি ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে হতে পারে বলে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়।

তাঁর এই বক্তব্য নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে শুধু একটি ধারণা দিয়েছে। এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি বিএনপি ও তাদের মিত্র দলসহ অনেকে। প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পর বিএনপি, তাদের শরিক ও বাম ঘরানার অনেক দল ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের দাবি তুলেছে।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গতকাল বলেছেন, ‘দেশ তো এক কঠিন পথে চলেছে। এ থেকে উত্তরণ পেতে হলে রাজনৈতিক দলকে আসতে দিন। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে তারা এসব সমস্যার সমাধান করবে। কাজেই আসুন, এ সময় আমরা সবাই মিলে সরকারকে সহায়তা করি; যাতে তারা সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে যেতে পারে। আমরা যেন তাদের ওপর বোঝা না চাপাই।’

সেনাপ্রধানের দেওয়া বক্তব্যে অনেক দ্বিধা কেটে যাবে বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দলটির নেতারা বলেন, সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য নিশ্চিতভাবেই দেশের জন্য ইতিবাচক বার্তা দেবে।

সরকার আন্তরিক হলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান।  তিনি বলেন, ‘২০২৫ সাল সরকার এবং সব রাজনৈতিক দলের জন্য অনেকটাই চ্যালেঞ্জের হবে। এই মুহূর্তের রাজনৈতিক পরিবেশে একটি গ্রহণযোগ্য  নির্বাচন করতে হলে সরকারকে সব দলের ভিন্নমতকে একটি সহমতের জায়গায় এনে নির্বাচনে যাওয়া কঠিন। কাজটি কঠিন হলেও সরকার আন্তরিক থাকলে ২০২৫ সালের শেষ দিকে গুছিয়ে আনতে পারবে। তবে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের দেওয়া নানা পরামর্শ কার্যকর করতে সরকারের সময় লাগতে পারে, সেটিও উতরে যাবে যদি সরকার চায়।’

গত ২১ নভেম্বর অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন প্রশ্নে এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দীন বলেছেন, নির্বাচন কমিশন থেকে এখনো নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা হয়নি। তবে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে জানানো সময় অনুযায়ী নির্বাচনী প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ইসি যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তা এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ এবং নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতির ঘোষণায় ইতিবাচক ধারণা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সরকার নির্বাচনের পথেই এগোচ্ছে।

সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সূত্রে জানা গেছে, সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে সরকার। সেই আলোচনার পর সংস্কার করতে কত সময় লাগবে সরকার একটি ধারণা দিতে পারে। তখন নির্বাচন কবে হতে পারে সুনির্দিষ্ট সময় পাওয়া যাবে।

তবে নির্বাচন নিয়ে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সংশয় মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে। দলগুলোর ধারণা, বৈষম্যবিরোধীরা নির্বাচন বিলম্বিত করতে চান। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সরকারের দুজন উপদেষ্টার বক্তব্যে দলগুলোর মধ্যে এই সংশয় তৈরি হয়েছে।

গত ১৮ নভেম্বর ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেয়ারটেকার সরকার নয়। তাই শুধু নির্বাচন দেওয়াই এই সরকারের কাজ নয়। এরই মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে।

গত ২৫ ডিসেম্বর সরকারের যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, সংস্কার কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু একটা নির্বাচন কিংবা ভোটের জন্য এত এত মানুষ জীবন দেয়নি।

তাঁদের বক্তব্য ও গত ৩১ ডিসেম্বর ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার পরিকল্পনা একসূত্রে গাঁথা বলে মনে করে বিএনপি। দলটির মতে, বর্তমান সরকার তাদের শাসন ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে নির্বাচন দিতে চায় না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু  বলেন, ‘দেশ একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য এ বছরের মধ্যে অতিদ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের উচিত রোডম্যাপ দিয়ে নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।’

গতকাল ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনাসভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি সময় সময় সংস্কার করে আসছে। কিন্তু সংস্কারের নামে গণতন্ত্র বিঘ্নিত করা যাবে না। সরকারকে অতিদ্রুত নির্বাচন দিয়ে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে।’

গত ২১ ডিসেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৫ সালের মধ্যেই হতে হবে, এ সময়ের মধ্যে সব সংস্কার শেষ করতে হবে।

এবি পার্টির সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, চলতি বছরের আগস্ট থেকে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। 

অবশ্য এর আগে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে। গত ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) উদ্যোগে আয়োজিত এক সম্মেলনে অংশ নিয়ে শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘আমাদের এই সরকার খুবই স্বল্পকালীন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আগামী বছরেই আমরা একটি রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার দেখব। জানি না কী হবে।’

গত ২১ নভেম্বর যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে সরকারের নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি কাঙ্ক্ষিত ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হতে পারে।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান পরবর্তী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারণার কথা জানান। সেনাপ্রধান বলেছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে এই সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।