ছড়া লিখে ওএসডি হলেন ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা

ছড়া লিখে ওএসডি হলেন ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা

প্রথম নিউজ, অনলাইন:  ঢাকা ওয়াসার কমন সার্ভিস বিভাগের উপসচিব শহিদুল ইসলাম ছড়া লিখে কড়া শাস্তির মুখে পড়েছেন। মঙ্গলবার (০৮ এপ্রিল) তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে এবং উপব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার (প্রশাসন) দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। এ নিয়ে একটি তদন্ত কমিটিও হয়েছে।

শহিদুল ইসলাম নিজের লেখা একটি ছড়া তার ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেন। ছড়ার বিষয় ছিল রাজধানীর আলোচিত সেই ঈদ শোভাযাত্রার নাসিরুদ্দিন হোজ্জা, যিনি গাধার পিঠে উল্টো দিকে ফিরে বসেছিলেন। পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এই শোভাযাত্রা আয়োজন করে। হোজ্জারূপী ওই চরিত্রটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা হয়।

শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘লেখালেখি পুরোনো অভ্যাস। এর দু-একটি ফেসবুকে শেয়ারও করি। ঈদের পর একটি ছড়া লিখে ফেসবুকে দিয়েছিলাম। হঠাৎ মঙ্গলবার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাকে তার কক্ষে ডেকে পাঠান। সেখানে গেলে জিজ্ঞেস করেন, ছড়াটি আমার লেখা কিনা? হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলে, কেন লিখেছি জানতে চান তিনি। আমি স্যারকে বলি, অভ্যাস থেকে মাঝেমধ্যে একটু-আধটু লেখালেখি করি। ছড়াটি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে লিখিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এরপর এমডি স্যার বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নিয়ে নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে কী লেখা যাবে, আর যাবে না– তা উল্লেখ রয়েছে। আমি বলি, স্যার, আমি তো কাউকে উদ্দেশ করে লিখিনি। ছড়াতে অপরাধ কী হয়েছে, তাও বুঝতে পারছি না। বিকেলে অফিস ছাড়ার সময় একটি অফিস আদেশ আমাকে দেওয়া হয়। সেখানে দেখি, আমাকে ওএসডি করা হয়েছে।’

ছড়া লেখায় কর্মকর্তাকে ওএসডি করার খবরে ঢাকা ওয়াসায় নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে তা গণমাধ্যমের নজরে আসে। কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি চাকরি করে অনেকেই সাহিত্যচর্চা করছেন। অতীতে অনেক কবি-সাহিত্যিক সরকারি চাকরিজীবী হয়েও ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করে কবিতা, গল্প ও গান লিখেছেন। কিন্তু শহিদুল ইসলামের নিছক রসাত্মক ছড়াকে পুঁজি করে এমন শাস্তি দেওয়া ঠিক হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার শহিদুল ইসলাম বর্তমানে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদের ঢাকা ওয়াসা কমিটির সহসভাপতি পদে রয়েছেন।

শহিদুল বিষয়ে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক ওয়াসা প্রকৌশলী জানান, গত বছরের ছাত্রদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন শহিদুল। ৪ আগস্ট ছাত্ররা যখন অসহযোগের ঘোষণা দেন তখন এই কর্মকর্তা শহিদুল প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন আজ যারা অফিসে উপস্থিত হবে না তাদের তালিকা করে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শহিদুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ কারণে তাকসিম এ খানের সময়ে নিয়োগ এবং উপসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া সত্ত্বেও তাকসিমই আবার প্রশাসন থেকে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে বিতাড়িত করেন এই উপসচিব শহিদুল ইসলামকে। তাকে পাঠানো হয় ওয়াসার লালমাটিয়ার প্রশিক্ষণ সেন্টারে। তাকসিম তাকে অনিয়ম দুর্নীতির কারণে সাসপেন্ডও করেন। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহিদুল নিজেকে বঞ্চিত দেখিয়ে বর্তমানেও নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আসছিল।

সাবেক এমপি নিক্সন চৌধুরীর অনুসারী এই শহিদুলকে প্রশাসনে ফিরিয়ে আনে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ওয়াসার বর্তমান প্রশাসন। শুধু তা-ই নয় আবার প্রশাসনে ফেরত এনে প্রশাসনের কর্তৃত্ব তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওয়াসা প্রশাসনে সব ধরনের নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতি গত কয়েক মাস ধরে তার হাতের ইশারায় হচ্ছে। আর এ সুযোগে শহিদুল পুরো আওয়ামী দোসরদের পদায়ন করছে একের পর এক। এই শহিদুল এবং আওয়ামী আমলে নিয়োগ পাওয়া বর্তমান ওয়াসা সচিব একে একে সব আওয়ামী সমর্থকদের রক্ষায় আদা-জল খেয়ে নেমেছেন বলেও ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলুর রহমান বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবী কী লিখতে পারবেন, কী পারবেন না, সে নিয়ে নির্দেশনা রয়েছে। তার লেখা ছড়ায় সে নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটেছে বলে মনে হয়েছে। ওয়াসা সচিবের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। দেখা যাক, কমিটি কী প্রতিবেদন দেয়।

শহিদুলের ছড়াটি পড়ার পর কবি মোহন রায়হান বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি বাকস্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে লেখালেখি করার জন্য। বাংলাদেশে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, সমালোচনা সহ্য করতে পারেনি। ছড়াটিতে সরকারের সমালোচনা আছে বলে মনে হয়নি। বরং গাধার পিঠে নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে যে অবয়বে তুলে ধরা হয়েছে, তা জামায়াতের এক নেতার প্রতিকৃতি মনে হতে পারে।’

একসময় আবু করিম নামে এক কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক লেখা লিখেছিলেন। পরে তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের পিএস হয়েছিলেন। যদিও শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হলে আবু করিমকে চাকরিচ্যুত করেন। মোহন রায়হান বলেন, ‘আমি মনে করি না শহিদুলের এ ছড়ার মধ্যে এমন কিছু আছে, যার জন্য তার পেশাগত জীবনে কোনো শাস্তি আরোপ হতে পারে বরং শাস্তি দিলে তার সৃষ্টিশীলতা বাধাগ্রস্ত হবে।’

ছড়ায় যা আছে

নাসিরুদ্দিন হোজ্জা

পেয়ো নাকো লজ্জা

ঘোড়ায় চড়িয়া তুমি হাঁটিয়া চলো

রসিকতায় শত কথা সত্যি বলো

গাঁধা নাকি ঘোড়া সে

কী করে কে বলে যে

গাঁধা হাঁটে চার পায়ে টগবগ

তোমার মতো নয় সে অযথাই বকবক

কেউ বলে তুর্কি কেউ বলে ইরানি

কখনও কি স্বাদ পেলে সুলতানি বিরানি

ঈদ এলে হেঁটেছো কি মুঘলের ঢাকাতে

কাণ্ড কি ঘটিয়েছ অযথাই হাসাতে

বহুকাল বাদে আজ তুমি দেখা দিলে

ঢাক ঢোলের তালে তালে

গাঁধার পশ্চাতে মুখ করে চলিলে উল্টো

আজব এক ঈদ গেলো ঘটনাটি ভুল তো?

যাই হোক জানি কম নাসিরুদ্দিন হোজ্জা

এতে তুমি পেয়ো না গো এতটুকু লজ্জা।

যা আছে আলোচিত ছড়ায়

নাসিরুদ্দিন হোজ্জা

পেয়ো নাকো লজ্জা

ঘোড়ায় চড়িয়া তুমি হাঁটিয়া চলো

রসিকতায় শত কথা সত্যি বলো

গাঁধা নাকি ঘোড়া সে

কি করে কে বলে যে

গাঁধা হাঁটে চার পায়ে টগবগ

তোমার মত নয় সে অযথাই বকবক

কেউ বলে তুর্কি কেউ বলে ইরানী

কখনও কি স্বাদ পেলে সুলতানী বিরানী

ঈদ এলে হেঁটেছ কি মুঘলের ঢাকাতে

কাণ্ড কি ঘটিয়েছ অযথাই হাসাতে

বহুকাল বাদে আজ তুমি দেখা দিলে

ঢাক ঢোলের তালে তালে

গাঁধার পশ্চাতে মুখ করে চলিলে উল্টো

আজব এক ঈদ গেলো ঘটনাটি ভুল তো?

যাই হোক জানি কম নাসিরুদ্দিন হোজ্জা

এতে তুমি পেয়ো না গো এতটুকু লজ্জা।