ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পায়ে গুলি আছে এখনো, মাঝেমধ্যে হারাচ্ছেন মানসিক ভারসাম্য

 ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পায়ে গুলি আছে এখনো, মাঝেমধ্যে হারাচ্ছেন মানসিক ভারসাম্য

প্রথম নিউজ, ঢাকা : রাজধানীর তেজগাঁওয়ের পূর্ব তেজতুরী বাজারে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত মানিক হোসেন।

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেট। ফার্মগেট থেকে সরকারি বিজ্ঞান কলেজের সামনের সড়ক ধরে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই রেললাইন সংলগ্ন তেজগাঁও পূর্ব তেজতুরী বাজার। রেললাইনের কিছুটা আগে এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের গাঁ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে একটি ছোট্ট ভাতের হোটেল।

পাঁচটি টেবিল বিশিষ্ট বাঁশ, কাঠ আর ত্রিপলের ছাউনি ঘেরা হোটেলটি ‘মানিকের সবজি হোটেল’ হিসেবে পরিচিত। দোকানের সামনেই লাগানো হয়েছে জুলাই আন্দোলনে পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আহত মানিক হোসেনের ছবি। কিন্তু প্রশ্ন হলো কে এই মানিক?

এই সবজি হোটেলের পাশেই ১২ থেকে ১৩ বছর চায়ের দোকান চালিয়েছেন মানিক। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের চাঁদাবাজি এবং অত্যাচারে দোকান বিক্রি করে লক্ষ্মীপুরে গ্রামের বাড়ি চলে যান তিনি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবার ঢাকায় ফিরে এসে ভাতের হোটেল দিয়েছেন মানিক।

চাঁদাবাজ ও অত্যাচারীদের দৌরাত্ম্য থেকে মানিক রক্ষা পেলেও বাঁ পায়ে জুলাই অভ্যুত্থানের ক্ষত চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। তার পায়ে বিঁধে রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ছোড়া গুলি। গুলির অসহনীয় যন্ত্রণা এখনো ভোগাচ্ছে তাকে। একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের ভয়াবহ বর্বরতায় ভীত হয়ে মাঝেমধ্যেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন।

    ৪ আগস্টের পর থেকে গুলির ব্যথা নিয়ে ভুগছেন মানিক। পরে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে চিকিৎসার কাগজপত্র জমা দেন। ১০ দিন পরে এক লাখ টাকা পান। আরও দুই লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ফাউন্ডেশন।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, রংচটা পুরাতন পাঞ্জাবি পরে আছেন মানিক। বয়স প্রায় ৩০ বছর। কিছুটা পাগলামির ভাবভঙ্গিতে ঘুরছেন এদিক সেদিক। কখনো গলা ছেড়ে গান গাইছেন। আবার কখনো দৌড়ে প্রায় ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে নানান অঙ্গভঙ্গি করে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছেন। দেখে চেনার উপায় নেই ছোট একটি খাবারের হোটেলের মালিক তিনি।

মানিক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, লক্ষ্মীপুরে আমের মেলা করতাম। যখন ছাত্র আন্দোলনে সাধারণ মানুষ সবাই নেমে গেছে, সবাই যখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, তখন আমিও লক্ষ্মীপুরে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপুর বাড়ির সামনে ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা অবস্থান নেয়। সেখানে আন্দোলনে অংশ নিলে আমার বাঁ পায়ে গুলি লাগে। পরে পাঁচ-ছয়জন ছাত্র আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করে। তখনও তো সরকার পতন হবে সেটা বুঝতে পারিনি। পরে তাদের (ছাত্রদের) বলি, ভাই সামনে তো আমার আমের মেলা। টিপু আমাকে চেনে। আমি যদি হাসপাতালে ভর্তি হই এবং সেটা যদি সে জানে তাহলে আমার অনেক ক্ষতি করবে।

“এরপর সেখান থেকে একটা সিএনজি নিয়ে আমার বাড়ি রামগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা দেই। রামগঞ্জের একটা প্রাইভেট হাসপাতালে গেলে তারা বলে এখানে গুলিবিদ্ধ লোকের চিকিৎসা হবে না। পরে আমি রামগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাই। আমার পায়ের গুলি লাগা স্থানে কেটে তারা গুলি বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু বের করতে পারেনি। পরে আমি সেখান থেকে চিকিৎসার একটা কাগজ নিয়ে দ্রুত বের হয়ে যাই। এরপর কাটা স্থানে সেলাই করতে আবার হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। তখন তারা আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘ভাই, আপনি এখানে আইসেন না। পুলিশ এসেছিল। এসে শুনছিল গুলিবিদ্ধ হয়ে কে যেন এসেছিল। আপনাকে অ্যারেস্ট করবে।’ আমি তখন সেলাই করতে আমাদের গ্রামের স্বপন ডাক্তারের কাছে যাই। তিনি বলেন, ‘গুলিসহ সেলাই করলে সমস্যা হতে পারে।’ পরে আমি জোর করেই গুলিসহ সেলাই করি। এরপর ৬ আগস্ট ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় এসে প্রথমে যাই আল রাজি হাসপাতালে। সেখান থেকে যাই পদ্মা হাসপাতালে। তার পরদিন ৭ তারিখ যাই ঢাকা মেডিকেলে। কোনো জায়গায় গিয়ে চিকিৎসা পাইনি। ডাক্তাররা আমাকে বলেন, ‘আপনার যে কাটাটা আছে এটা তো সেলাই করা। অন্য জায়গায় কাটলে পাশাপাশি দুইটা কাটা হলে ইনফেকশন হবে। এখন আমার বুলেটটা বের করতে হলে কাটাটা শুকানোর পর বের করতে হবে।’ তারা বলছে এই বুলেট না বের করলেও নাকি সমস্যা নেই।” বলছিলেন মানিক।

সেই থেকে গুলির ব্যথা নিয়ে ভুগছেন মানিক। পরে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে চিকিৎসার কাগজপত্র জমা দেন তিনি। ১০ দিন পরে এক লাখ টাকা পান। আরও দুই লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ফাউন্ডেশন।

‘সৎপথে ১০ টাকা পেলেই খুশি’ উল্লেখ করে মানিক বলেন, ‘এই যে হোটেলটা করছি, এখান থেকে দুই টাকা ইনকাম করছি, খাচ্ছি; এতেই আমি খুশি। তারপরেও আমার এই হোটেলটা অনেকেই বিভিন্নভাবে ভাঙতে চাইছিল, আমি বাধা দিছি। তারা বলছে সবার দোকান উঠলে আমার দোকানও উঠে যেতে হবে। তবে তারা কোনো চাঁদা চায়নি। পরে আমি আমার আহত হওয়ার ছবি লাগাইছি।’

পায়ে গুলি আছে এখনো, মাঝেমধ্যে হারাচ্ছেন মানসিক ভারসাম্যপূর্ব তেজতুরী বাজারে রাস্তায় ঝাড়ু দিচ্ছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত মানিক হোসেন। ছবি: জাগো নিউজ

২০১৮ সালের কথা তুলে ধরে মানিক বলেন, ‘আমি বিএনপি করতাম। এই অপরাধে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের ১৭ জন মিলে আমাকে মারতে মারতে এই বিল্ডিং (সামনে অবস্থিত ভবন) থেকে নিচে নামায়।’

পূর্ব তেজতুরী বাজার এলাকায় ১২ থেকে ১৩ বছর ধরে থাকেন মানিক হোসেন। সবজির হোটেলের পাশের চায়ের দোকানটি এক সময় তার ছিল।

মানিক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও পুলিশের লোকজনকে এই চায়ের দোকান থেকে দিনে ৫০ টাকা, রাতে ৫০ টাকা, সপ্তাহে ২৫০ টাকা ও মাসে এক হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হতো। আমার বাপেরে নিয়ে দোকানদারি করতাম। ২০২২ সালের দিকে একদিন আমার বাপে অসুস্থ। তারে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। তিন-চারদিন পর দোকান খুলছি। তখন ওরা (পুলিশ) আসছে চাঁদার জন্য। আমি চাঁদা দেই নাই দেখে মিথ্যা মামলা দিয়ে ধরে নিয়ে যায়। তারপর আমার দোকানপাট ভেঙে দেয়।’

    ‘মানিক ভাইয়ের পায়ের ভেতরে এখনো একটা গুলি আছে। বের করতে পারেনি। এই গুলি খাওয়ার পর থেকে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন সমস্যা হয়। ভয়ে ব্রেন আওলাইয়া যায়। কয়েকদিন পাগলামো করে, আবার ভালো হয়। কয়েকদিন পর আবার পাগলামো করে।’- হোটেল কর্মচারী মো. রাজিব।

মানিকের সবজি হোটেলে দুই মাস ধরে মাসিক ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছেন কর্মচারী মো. রাজিব। তিনি বলেন, ‘মানিক ভাইয়ের পায়ের ভেতরে এখনো একটা গুলি আছে। বের করতে পারেনি। এই গুলি খাওয়ার পর থেকে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন সমস্যা হয়। ভয়ে ব্রেন আওলাইয়া যায়। কয়েকদিন পাগলামো করে, আবার ভালো হয়। কয়েকদিন পর আবার পাগলামো করে। গুলি খাওয়ার পর আতঙ্কে এমন হয়েছে।’

    ‘টাকার অভাবে মানিকের পা থেকে গুলি বের করা সম্ভব হচ্ছে না। নানা রকম টেনশন ও ভয়ে ওর ব্রেনে সমস্যা দেখা দিছে। যে ডাক্তাররা পায়ের চিকিৎসা করছে তারা ভালো মানসিক ডাক্তার দেখাইতে বলছে।’ -মানিকের বাবা নুরুল আমিন

বাবা-মা, তিন ভাই ও দুই বোন নিয়ে মানিকদের সংসার। বাবা-মা ও দুই বোন থাকেন লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে। তিন ভাই ঢাকায় কাজ করেন। এর মধ্যে ছোট ভাই তেজগাঁও বিজ্ঞান কলেজের পাশে সাইকেলের পার্টসের একটি দোকানে চাকরি করেন।

মানিকের বাবা নুরুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘টাকার অভাবে মানিকের পা থেকে গুলি বের করা সম্ভব হচ্ছে না। নানা রকম টেনশন ও ভয়ে ওর ব্রেনে সমস্যা দেখা দিছে। যে ডাক্তাররা পায়ের চিকিৎসা করছে তারা ভালো মানসিক ডাক্তার দেখাইতে বলছে। কিছু ডাক্তার দেখাই ছিলাম। কিন্তু তাকে তো জোর করেও হাসপাতালে নেয়া যায় না। ভর্তি করান ছাড়া তো কিছু করন যায়তো না। তার মাও পাগলের মতোন হয়ে রইছে। কিছুদিন আগে ব্রেনের সমস্যা হইছিল। তখন মানিকের বড় ভাই ওকে জোর করে নিয়ে আসছিল। তারপর রাত ১২টার পর আবার পালায় চলে গেছে। পরে সারা রাত খুঁজে বেড়াইছি। একদিন পর খবর পাইছি ঢাকা চলে গেছে।’