গুলিতে হাত-পা হারানো হাসপাতালের বেডে অসহায়দের আহাজারি

কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহতদের অনেকেই এখনও হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন।

গুলিতে হাত-পা হারানো হাসপাতালের বেডে অসহায়দের আহাজারি

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: ১৯ বছরের আকতার হুসেনের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছিল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। কোমরের নিচের অংশ কাঁথা দিয়ে ঢাকা। কাছে গিয়ে গুলিতে আহত কি না প্রশ্ন করতেই কেঁদে ওঠেন এই তরুণ। গা থেকে কাঁথা সরিয়ে দিতে বলেন। আর তখন দেখা গেল তার বাম পায়ের অর্ধেকটা নেই। কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত ব্যান্ডেজে মোড়ানো। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসা চলছে তার।

 চিটাগাং রোড এলাকার একটা সেলুনে কাজ শিখতেন আখতার। প্রতিদিনের মতো গত শনিবারও তিনি সেলুনে গিয়েছিলেন। বিকেলে চিটাগাং রোড এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছিল। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি বাসায় ফেরার জন্য বের হন। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় বের হলে আবার গোলাগুলি শুরু হয়, অন্য মানুষের দেখাদেখি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আমিও দৌড় শুরু করি। তখন একটা গুলি এসে আমার বাম পায়ে লাগে। আমার শরীরে একাধিক অপারেশন হয়েছে, বড় একটা অপারেশনের মাধ্যমে গত সোমবার বাম পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ কেটে ফেলা হয়েছে।’ 

শুধু আকতার নন, পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-২ ওয়ার্ডে এ রকম আরও ৩৬ রোগী আছে। তাদের ৬ জনের বাম বা ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় পা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন আরও অনেকে। হাতে গুলি লেগেও কেউ কেউ গুরুতর আহত হয়েছেন, ৬ জনের হাত কেটে ফেলতে হতে পারে। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন হাত-পা যাতে কেটে ফেলতে না হয়। তবুও অনেকের শেষ রক্ষা হবে কি না, নিশ্চিত নন। তাদের কারও লেগেছে একটি গুলি, কারও একাধিক; ছররা গুলিও শরীরে নিয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন তারা।  কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে তারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। চিকিৎসাধীন রোগীদের বেশিরভাগের দাবি, তারা বিক্ষোভ কিংবা সংঘর্ষে অংশ নেননি, জরুরি কাজে কিংবা জীবিকার তাগিদে বাসা থেকে বের হয়ে সংঘর্ষের মাঝে পড়ে কিংবা নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে যাওয়ার সময় গুলি লেগেছে তাদের।

পঙ্গু হাসপাতালের তথ্যকেন্দ্র থেকে জানা গেছে, ১৭ থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ৮০০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। ২৩১ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিয়েছেন। কোন ওয়ার্ডে কতজন কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন, আলাদাভাবে সে তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়নি। 

হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন গুলিবিদ্ধ প্রাইভেট কারের চালক সজীব খান। গত শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে তার ডান হাতে গুলি লাগে। তার হাত কেটে ফেলতে হবে কি না চিকিৎসকরা এখনো নিশ্চিত নন। সজীব খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম, তখন বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তুমুল সংঘর্ষ চলছিল। পুলিশের একটি গুলি এসে আমার হাতে লাগে। পুলিশের গুলিতে আমিসহ অনেকেই আহত হন; গুলিতে একটা কুকুরও মারা গেছে।’  তিনি বলেন, ‘আমার হাতে একটা গুলি লেগে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। হাত কেটে ফেলতে হয় কি না, সে চিন্তায় দিন কাটছে।’ 

অসহায় দৃষ্টিতে তার পাশে বসেছিলেন স্ত্রী শেফালি বেগম। তিনি বলেন, ‘তিনজনের সংসারে স্বামীই একমাত্র উপার্জনকারী। মানুষটি গুলি নিয়ে হাসপাতালে, ডাক্তাররা বলছেন হাত যদি কেটে না-ও ফেলা হয়, আগামী দেড়-দুই বছর কোনো কাজ করতে পারবে না। কাজ না করলে আমাদের মুখে খাবার দেবে কে? এখন আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু গ্রামে গেলেও কে আমাদের খাওয়াবে। আমাদের রাস্তায় বসা ছাড়া উপায় নেই।’ 

তিনটি হাসপাতাল ঘুরে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে ১৬ বছরের কারখানা শ্রমিক নাজিম। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকার একটি এমব্রয়ডারি কারখানায় কাজ করে রিকশাচালক বাবাকে পরিবার চালাতে সহযোগিতা করে নাজিম। পঙ্গু হাসপাতালে বসে সেদিনের বর্ণনা দেয়। নাজিম বলে, ‘শনিবার বিকেল ৫টার দিকে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলাম। চিটাগাং রোডে গোলাগুলি হচ্ছিল। চারদিকে মানুষ দৌড়াচ্ছিল। হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ছোড়া হচ্ছিল। আমার বাম পায়ে একটা গুলি লাগে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।’ মা মরিয়ম বেগম বলেন, ‘আমার ছোট বাচ্চাটাকে গুলি করা হলো, এ বয়সে তার একটা পা কেটে ফেলা হয়েছে। তার জীবন কীভাবে চলবে, এ কথা আমি কাকে বলব?’

নাজিমকে আরও ১ মাসের বেশি হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। তাকে প্রথমে নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে ব্যান্ডেজ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে হৃদরোগ হাসপাতাল হয়ে পঙ্গুতে এখন তার চিকিৎসা চলছে। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের ৩০ জনের অবস্থা বেশি খারাপ। তাদের একাধিক অপারেশন লাগবে। ইতিমধ্যে অনেকের পা কেটে ফেলা হয়েছে। একেক জন রোগীর ৪-৮টি অপারেশন করতে হচ্ছে। এত অপারেশনের সুবিধা হাসপাতালে নেই।

একাধিক রোগীর অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের সিরিয়াল পেতে দিন পার হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসক ও নার্সদের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও সুযোগ মিলছে না। এতে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয় পাচ্ছেন স্বজনরা। শুক্রবার বিকেলে রায়েরবাগ এলাকায় গুলি লাগে ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী রফিকের। তার ভাই নাদিম জানান, ‘ইতিমধ্যে ২টা অপারেশন করা হয়েছে। মঙ্গলবার চিকিৎসকরা বলেছিলেন আরও ৩-৪টা অপারেশন লাগবে। এরপর আমরা আর সিরিয়াল পাচ্ছি না।’

পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন ২০-২১টা রুটিন অপারেশন করা হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে ৪০-৫০টা অপারেশন করা সম্ভব হয়। এক সপ্তাহ ধরে অপারেশনের চাপ অনেক বেড়েছে। যে রোগীদের অবস্থা বেশি খারাপ, তাদের আগে অপারেশনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। শুধু যে আন্দোলনে আহত রোগীদের অপারেশন প্রয়োজন তা নয়, এর বাইরেও অনেক রোগীর অপারেশন প্রয়োজন। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি পরিস্থিতি সামাল দিতে।’