গণপূর্তের জমিতে মসজিদের ব্যানার টাঙিয়ে মার্কেট
দীর্ঘ ছয় মাস ধরে প্রশাসনের নাকের ডগায় এ মার্কেট নির্মাণ করা হলেও কার্যত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
প্রথম নিউজ,ঢাকা: কক্সবাজারে গণপূর্ত অধিদফতরের জমিতে প্রথমে মসজিদ নির্মাণের ব্যানার টাঙিয়ে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে জেলা কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতি। পরে ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হলে সেই ব্যানার সরিয়ে ফেলা হয়। সেখানে মসজিদের ব্যানারে নির্মিত হয়েছে মার্কেট। বর্তমানে মার্কেটের ১১টি কক্ষ নির্মিত হয়েছে। রাখা হয়নি মসজিদের জন্য কোনও স্থান। দীর্ঘ ছয় মাস ধরে প্রশাসনের নাকের ডগায় এ মার্কেট নির্মাণ করা হলেও কার্যত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
কক্সবাজার শহরের পুলিশ সুপারের (এসপি) কার্যালয়ের দেয়াল ঘেঁষে শহীদ সরণিতে গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেটটি। নির্মাণের সময় মসজিদের ব্যানার টাঙিয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও নেওয়া হয়। কিন্তু, ভবন নির্মাণ যখন শেষ পর্যায়ে তখন উধাও হয়ে যায় ব্যানারটি। একইভাবে আত্মসাৎ করা হয় মসজিদের জন্য উত্তোলিত টাকাও।
এ বিষয়ে গত ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগের সংশ্লিষ্টরা সদর থানায় জিডির পাশাপাশি জেলা প্রশাসক এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়ে দায় ছেড়েছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
সর্বশেষ চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কক্সবাজার জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের একটি দল অভিযান চালিয়ে ঘটনার সত্যতা পায়। পরে দলটির নেতৃত্ব দানকারী দুদকের সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন প্রধান কার্যালয়ে সরকারি জমি উদ্ধারের সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদন পাঠান। তবে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনও নির্দেশনা আসেনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গণপূর্ত বিভাগের সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য মতে, কক্সবাজার শহরের শহীদ সরণির জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে রাস্তার পাশে গণপূর্ত বিভাগের মালিকানাধীন সাত শতক জমি রয়েছে। ওই জমি গত ২০ বছর ধরে অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে জেলা কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতি।
গত বছর নভেম্বর মাসে দখল করা ওই জায়গায় চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতি বহুতল ভবন নির্মাণকাজ শুরু করলে গণপূর্ত বিভাগ আপত্তি জানায়। এখন সেখানে পাকা স্থাপনার মার্কেট নির্মাণ করে দোকান ভাড়া দিয়েছে। আর প্রতিটি দোকান ভাড়ার চুক্তি বাবদ প্রতি জনের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে আট থেকে দশ লাখ টাকা।
এ নিয়ে গণপূর্ত বিভাগ কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টির ব্যাপারে তিনি অবগত নন বলে জানান। এ ব্যাপারে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী বলেন, ‘কক্সবাজার শহরে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের পাশে গণপূর্ত বিভাগের মালিকানাধীন কিছু পরিমাণ জায়গা দীর্ঘ বছর ধরে অবৈধভাবে ভোগ-দখলে রেখেছে জেলা কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতি। গত বছর নভেম্বর মাসে সমিতির উদ্যোগে সেখানে পাকা স্থাপনার বহুতল ভবন নির্মাণকাজ শুরু করে। বিষয়টি নজরে এলে গণপূর্ত বিভাগ আপত্তি জানায়। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতি আপত্তি অমান্য করে বহুতল ভবনের পাকা স্থাপনা নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখে। তিনি আরও বলেন, ‘গত বছর ৩০ নভেম্বর আমি বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর থানায় অবৈধভাবে সরকারি জায়গা দখলের অভিযোগে সমিতির বিরুদ্ধে একটি জিডি করেছি। এরপর জায়গা থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত আবেদন করেছি।’
কউক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে গণপূর্ত বিভাগের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘ইতোমধ্যে দখলকৃত জায়গায় বহুতল ভবনের একতলা পাকা স্থাপনার মার্কেট নির্মাণকাজ শেষ করেছে জেলা চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতি। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নির্মিত দোকানঘর বিভিন্ন লোকজনের কাছে ভাড়াও দিয়েছে। অথচ অভিযোগ জানানোর অন্তত সাত মাস পেরিয়ে গেলেও জেলা প্রশাসন ও কউক কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি থানা পুলিশও ঘটনার ব্যাপারে কোনও ধরনের প্রতিবেদন দেননি।’
সচেতন মহল ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গণপূর্ত বিভাগের মালিকাধীন সরকারি মূল্যবান জায়গা দখলে নিতে জেলা কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতি বহুতল ভবন নির্মাণে অভিনব প্রতারণার আশ্রয় নেয়। ভবনটির নির্মাণকাজ শুরুর আগে সমিতির উদ্যোগে ওই জায়গায় ‘মসজিদ স্থাপনের’ ব্যানার লাগায়। এমনকি সমিতির দায়িত্বরতরা মসজিদ নির্মাণের নামে স্থানীয় বিশিষ্টজনের কাছ থেকে অনুদানের নগদ টাকাও সংগ্রহ করেছে। কিন্তু সরকারি ওই জায়গায় মসজিদের বদলে নির্মিত হয়েছে বাণ্যিজিক ভবনের মার্কেট। এখন ওই মার্কেটের দোকানগুলো মোটা অঙ্কের টাকায় চুক্তি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
বছরখানেক আগে সমিতির উদ্যোগে প্রস্তাবিত কথিত মসজিদের জন্য অনুদান প্রদানকারী স্থানীয় সমাজকর্মী সরওয়ার আলম বলেন, ‘জেলা চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতির দায়িত্বরতরা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের পাশের জায়গায় একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য আমার কাছে অনুদান সহায়তা চান। প্রাথমিকভাবে অনুদান বাবদ ১০ হাজার টাকা দিই। কিন্তু পরে জানতে পারি, মসজিদ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত জায়গাটি গণপূর্ত বিভাগের মালিকাধীন। আর জায়গার মালিকানা নিয়ে সমিতির সঙ্গে গণপূর্ত বিভাগের বিরোধ রয়েছে। মূলত বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য মসজিদ স্থাপনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে প্রতারণার উদ্দেশ্যে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জেলা চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতি মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে আরও অনেকের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করেছে। প্রস্তাবিত মসজিদের জায়গায় এখন নির্মিত হয়েছে বাণ্যিজিক ভবন। আর সমিতির দায়িত্বরতরা মসজিদ নির্মাণের নাম করে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করেছে।’
এদিকে, চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি সরকারি মূল্যবান জায়গা দখল করে বাণ্যিজিক ভবন নির্মাণের অভিযোগ তদন্ত করে সত্যতা পান দুদকের কক্সবাজার জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন। এ প্রসঙ্গে রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘কক্সবাজার শহরে পুলিশ সুপার কার্যালয় সংলগ্ন এলাকায় জেলা চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতির উদ্যোগে সরকারি জায়গা দখল করে বাণিজ্যিক বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগে দুদকের একটি দল অভিযান চালিয়েছিল। অভিযানে অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে জায়গা দখলের অভিযোগের সত্যতা পায় দুদক। এর পরপরই জেলা চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতির উদ্যোগে নির্মিত ও নির্মাণাধীন সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ করে সরকারি জায়গা উদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সুপারিশ আকারে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেদন পাঠানোর প্রায় সাত মাস অতিক্রান্ত হলেও দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এখন পর্যন্ত কোনও ধরনের নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।’
অভিযোগের ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম জানান, তিনি এসবের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নন। প্রস্তাবিত মসজিদ ও মার্কেট নির্মাণের জন্য সমিতির সভাপতিসহ পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। সমিতির ওই কমিটির সদস্যরাই এ ব্যাপারে অভিযোগের ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। তিনি অভিযোগের বিষয়ে সমিতির সভাপতির সঙ্গে কথা বলতে প্রতিবেদককে পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ হলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজ বলেন, ‘যেহেতু কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারীরা কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের আওতাভুক্ত, তাই বিষয়টি আমাদের ওপর বর্তায়। এজন্য আমি নিজে গিয়ে ভবণ নির্মাণ করতে নিষেধ করেছি। আমি তাদের (কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী) পরিষ্কার বলে দিয়েছি, জমিটি গণপূর্ত বিভাগের। তাদের অনুমতি ছাড়া কোনও বন্দোবস্তও দেওয়া যাবে না। বন্দোবস্ত পেতে হলে গণপূর্তের লিখিত অনুমতি লাগবে। তিনি জানান, গণপূর্ত বিভাগের জমিতে ভবন নির্মাণের বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ দায়িত্ব নেবে, জেলা প্রশাসন নয়।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews