ঐকমত্য কমিশন- জরুরি অবস্থা জারির প্রক্রিয়া নিয়ে একমত

ঐকমত্য কমিশন- জরুরি অবস্থা জারির প্রক্রিয়া নিয়ে একমত

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ১৪১ (ক) এ সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় যুক্ত করার প্রস্তাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা অথবা তার অনুপস্থিতিতে বিরোধীদলীয় উপনেতাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। বিষয়গুলো হলো- অনুচ্ছেদ ১৪১ (ক) সংশোধনের সময় ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগের’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি বা মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি স্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদন যুক্ত করতে হবে। গতকাল রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার ১২তম দিনের আলোচনা শেষে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময়ে অনুচ্ছেদ ৪৭ (ক) এর বিধান সাপেক্ষে, কোনো নাগরিকের জীবনের অধিকার (জরমযঃ ঃড় ষরভব) এবং বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে বিদ্যমান সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ খর্ব করা যাবে না। উল্লেখ্য, গত ৭ই জুলাইয়ের আলোচনায় বিদ্যমান সংবিধানের ১৪১ (ক) অনুচ্ছেদ সংশোধন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা যেন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহার না হয়, সে বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল এবং জোট একমত হয়েছিল।

আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দল এবং জোটসমূহ আজ প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ৯৫ এ সুস্পষ্টভাবে কিছু বিষয় যুক্ত করার প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেছে। এক্ষেত্রে যা যুক্ত করতে হবে, রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দান করবেন। অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তবে তারা সংবিধানে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুইজন বিচারপতির মধ্যে থেকে যেকোনো একজনকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দান করবেন- এমন বিধান সংযোজন করতে পারবে। তবে শর্ত থাকে যে, অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের অভিযোগের কারণে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬ এর অধীন কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান থাকলে, তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে না। বৈঠক শেষে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জরুরি অবস্থা জারি একটা ব্যাপক টার্ম। এটার একধরনের অপব্যবহার করার সুযোগ ছিল। এজন্য এটা সংশোধন করে তদস্থলে কি সংযুক্ত করা যায়। এ বিষয়ে আজকে একটা সিদ্ধান্তে আসা গেছে। ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি বা মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপনে আমাদের ও আরও অনেকের প্রস্তাব ছিল। আরেকটি বিষয় ছিল কন্সটিটিউশনাল ক্রাইসিস যদি হয়, সেটা আলোচনা হয়নি। অভ্যন্তরীণ শব্দ দু’টির জায়গায় এই শব্দগুলো যুক্ত হবে এ বিষয়ে একমত হয়েছে।

তিনি বলেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় রাষ্ট্রপতির প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার প্রতি স্বাক্ষর আছে। এখানে শুধু প্রধানমন্ত্রীর প্রতি স্বাক্ষর না রেখে মন্ত্রিসভার অনুমোদন কমিশনের প্রস্তাব ছিল। সে বিষয়ে আমরা আগেই একমত পোষণ করেছিলাম। আজকে সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছে সবাই। তবে এডিশন আসছে অনেকের প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা বা তার অনুপস্থিতিতে বিরোধীদলীয় উপনেতা যেন অংশগ্রহণ করেন- এটা সংযুক্ত করা হয়েছে। জরুরি অবস্থা জারি হলেও ‘রাইট টু লাইফ’ এটা যেন প্রটেক্টেড থাকে। 

প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, রাষ্ট্রপতির স্বাধীন ক্ষমতায় প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হয়। তবে আমাদের দলের প্রস্তাব ছিল, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ তিনজনের মধ্যে থেকে নিয়োগ দেয়া হোক। পরে আলোচনায় এসেছে, জ্যেষ্ঠ দুইজনের মধ্য থেকে নির্বাচন করা হতে পারে। যদিও অনেক দল জ্যেষ্ঠতম একজনকেই নিয়োগ দেয়ার পক্ষেই মত দিয়েছেন। আমরা বলেছি, অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, সবচেয়ে সিনিয়র কেউ কেউ বিতর্কিত কিংবা দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারেন। এজন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যদি আগে কোনো নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ দিয়ে থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তি বাদ যাবেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জুডিশিয়ারি বাদ রেখে বিকল্প কয়েকটি প্রস্তাব রাখা যায় কিনা, এ ব্যাপারে সবাই একমত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের ব্যাপারে সবাই একমত। আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মধ্যে যেটা আছে পুরোটাই জুডিশিয়ারি নির্ভর। জুডিশিয়ারির বাইরে কয়েকটি প্রস্তাবে যদি আমরা সবাই মিলে একমত হতে পারি- তাহলে জুডিশিয়ারিকে বিতর্কের বাইরে রাখা যায়। সর্বশেষ অপশন হিসেবে সবাই একমত হয়েছে রাষ্ট্রপতিকে রাখা ঠিক হবে না। আমরাও বলি, রাষ্ট্রপতিকে না রাখতে পারলেই ভালো। 

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর  ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জরুরি অবস্থা জারিতে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বিরোধীদলীয় নেতা বা উপনেতার মতামত নিতে হবে। এরপর অধ্যাদেশ জারি করবেন রাষ্ট্রপতি। এ বিষয়ে বেশির ভাগ দলই একমত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, জামায়াত চায় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিই হবেন প্রধান বিচারপতি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা সম্পন্ন না হলেও, আমরা চাই এটি যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। 

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, জরুরি অবস্থা কীভাবে জারি হবে, এটি একটি অমীমাংসিত বিষয় ছিল। আজকে দীর্ঘ আলোচনার পরে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে যেটা বলা হয়েছে- ১৪১ অনুচ্ছেদের ক- যেটা সংশোধন হবে। রাজনৈতিকভাবে দমন নিপীড়নের উদ্দেশ্যে জরুরি অবস্থা কোনোভাবেই জারি হবে না। 

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সদস্য জাবেদ রাসিম বলেন, আমরা জরুরি অবস্থাকে তিনটি ভাগ করতে বলেছিলাম, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারি এবং অভ্যন্তরীণ গোলযোগের ক্ষেত্রে। অভ্যন্তরীণ গোলযোগের পরিবর্তে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বা ভৌগোলিক অক্ষণ্ডতার প্রশ্নে যদি জরুরি অবস্থা জারির মতো পরিস্থিতি দেখা দেয় সেই ক্ষেত্রে সরকার জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবে। আগে যেমন রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর অনুস্বাক্ষরে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারতেন, সেখানে সেটা মন্ত্রী সভায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কলেবর একটু বর্ধিত করা হয়েছে, এ বিষয়ে আমরা এনসিপি একমত পোষণ করেছি।

বৈঠকে কমিশনের সদস্য হিসেবে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী,  জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি-সহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।