এনআইডি ছবির সঙ্গে মিলছে না চেহারা, অনলাইন জিডিতে বিড়ম্বনা

ভিশন- ২০২১ এর আওতায় ১০টি কৌশলগত লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সব থানায় ইলেকট্রনিক জিডি ও এফআইআর চালু করা।

এনআইডি ছবির সঙ্গে মিলছে না চেহারা, অনলাইন জিডিতে বিড়ম্বনা

প্রথম নিউজ, ঢাকা: প্রযুক্তিনির্ভর একুশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের সেবা খাতকে প্রযুক্তির শীর্ষে নিতে ভিশন-২০২১ ঘোষণা করা হয়েছে। সেই আলোকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেবা সহজতর করতে ২০১০ সালেই সারাদেশে প্রতিটি থানায় ইলেকট্রনিক এফআইআর ও জিডি চালুর পরিকল্পনা করা হয়। তবে সেটি আনুষ্ঠানিক পূর্ণতা পায় ২০২২ সালে।

ভিশন- ২০২১ এর আওতায় ১০টি কৌশলগত লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সব থানায় ইলেকট্রনিক জিডি ও এফআইআর চালু করা। চলতি বছরের ২১ জুন তা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

থানা পুলিশের চাপ কমানো এবং প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পুলিশের সেবাপ্রত্যাশীদের ভোগান্তি কমাতে মূলত চালু করা হয় অনলাইন জিডি প্রক্রিয়া। তবে অনলাইন জিডি অ্যাপসে জিডি করার ক্ষেত্রে ভোগান্তি-বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে সেবাপ্রত্যাশীদের। এনআইডি ছবির সঙ্গে বর্তমান ছবির মিল পাওয়া যাচ্ছে না অনেকের। কেউ আবার পাসওয়ার্ড দিলেও নিচ্ছে না।

ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতাদের দাবি, অনলাইন জিডি প্রক্রিয়া একটা সফল উদ্যোগ। কিন্তু জিডি এন্ট্রির আগে কঠিন প্রক্রিয়ার কারণে অনলাইন জিডি করাটা এখন বিড়ম্বনায় পরিণত হয়েছে। এটা আরও সহজ করা উচিত।

পুলিশ সদর দপ্তরের আইসিটি, ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, অ্যাপসটি সম্পর্কে ব্যবহারকারী সেবাগ্রহীতাদের ফিডব্যাক বা অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা চলছে। তথ্যগত নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু প্রক্রিয়া কঠিন মনে হচ্ছে। অনেকের ফেস ম্যাচিং-এ সমস্যা হচ্ছে। অ্যাপসটি আরও সহজতর করতে কাজ চলছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, পুলিশের আধুনিকায়নে যুক্ত হওয়া অনলাইন জিডি কার্যক্রমের সফটওয়্যারটি সিডিএমএস++ সফটওয়্যারের সঙ্গে এপিআই-এর মাধ্যমে সংযুক্ত। ২০১১ সালে সিডিএমএস সফটওয়্যার তৈরি করা হয়। বর্তমানে এটা বাংলাদেশের সব থানায় দায়ের করা এফআইআর এবং এফআইআর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্যাদির ডিজিটাল রেকর্ড হিসেবে কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে।

অনলাইন জিডির বর্তমান সফটওয়্যারটির নির্মাণ শুরু হয় ২০১৯ সালে। ২০২০ সালের জুন থেকে এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হয়। ২০২২ সালের জুনে শুভ উদ্বোধন করা হয়।

করোনা মহামারির মধ্যেও অনলাইন জিডির কাজ বন্ধ রাখেনি পুলিশ। পুলিশ নিজ উদ্যোগে ৬৪ জেলায় আট মেট্রোপলিটন ও ৬৬২ থানায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল প্রশিক্ষিত করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং সরকারের ভিশন- ২০২১ এর লক্ষ্য অর্জনে প্রশিক্ষিত জনবল নিয়ে অনলাইন জিডি চালুর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। সফটওয়্যারটির মোবাইল অ্যাপস এবং ওয়েব সংস্করণ ব্যবহার করে সেবাগ্রহীতা ঘরে বসেই জিডিযোগ্য বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ রেকর্ড করতে পারবেন এবং এ বিষয়ে গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী আপডেট জানতে পারবেন।

অন্যদিকে, থানায় দায়িত্বরত ডিউটি অফিসার অভিযোগপ্রাপ্তির ব্যবস্থা গ্রহণসহ থানার সব কার্যক্রম ডিজিটাল জেনারেল ডায়েরিতে এন্ট্রি করবেন এবং পিআরবি প্রবিধি মোতাবেক ২০০ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট জেনারেল ডায়েরি বই বাঁধাই করে সংরক্ষণ করবেন। একই সঙ্গে থানার ওসি, সার্কেল বা জোনাল অফিসারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ তাদের সার্বিক তদারকি কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারবেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট ও আইসিটি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত দুই পদ্ধতিতে করা যাচ্ছে অনলাইন জিডি। একটি ওয়েবসাইট ( GD.POLICE.GOV.BD) থেকে। অপরটি অনলাইন জিডি অ্যাপস (ONLINE GD) থেকে। দুই পদ্ধতিতে এখন পর্যন্ত শুধু হারানো অভিযোগগুলো করা যাচ্ছে।

সর্বশেষ চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই প্রক্রিয়ায় জিডি নথিভুক্ত হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৮৫৫টি। এর মধ্যে শীর্ষ ১০টি থানার মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানা। এ থানায় হওয়া জিডির সংখ্যা ১৩ হাজার ৭৩৯টি। এরপর মাদারীপুর সদর থানায় পাঁচ হাজার ৯৬৪টি, ভাটারা থানায় তিন হাজার ৪৪২টি, ভৈরব থানায় দুই হাজার ৩৮০টি, আখাউড়া থানায় দুই হাজার ২৫০টি, ডুমুরিয়া থানায় দুই হাজার ২৩৫টি, কুষ্টিয়া সদর থানায় দুই হাজার ২২০টি, সোনাডাঙ্গা থানায় দুই হাজার ১৩৭টি এবং পাইকগাছা থানায় দুই হাজার ১২টি জিডি নথিভুক্ত হয়েছে।

আশিকুর রহমান একটি বেসরকারি অফিসে আইটি বিভাগে কাজ করেন। তিনি বলেন, গত রমজানে আমার এনআইডি কার্ড ও পাসপোর্ট হারিয়ে যায়। ওমরা হজে যাব ভেবে বিড়ম্বনা এড়াতে জিডি করার সিদ্ধান্ত নিই। অফিসিয়াল ও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে অনলাইনে জিডি করতে বসি। কিন্তু কোনোভাবেই আমার এনআইডি কার্ডের ছবির সঙ্গে বর্তমান ছবির ফেস ম্যাচিং করতে পারিনি।

শফিকুল ইসলাম নামের বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, আমি গবেষণা নিয়ে কাজ করছি। গবেষণা সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হারিয়ে যায়। যা আমাকে পুনরায় বিভাগ থেকে উত্তোলন করতে হলে জিডির কপি প্রদর্শন করতে বলা হয়। আমি অনলাইন জিডির অ্যাপসে জিডি এন্ট্রি করার চেষ্টা করি। সেখানে আগে রেজিস্ট্রেশন করতে বলা হয়। আমি রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে হাস্যকর বিড়ম্বনায় পড়ি। কোনোভাবে পাসওয়ার্ড নিচ্ছিল না। পাসওয়ার্ডের জন্য কমপক্ষে একটি বিশেষ অক্ষর, একটি বড় অক্ষর এবং সংখ্যাসহ সর্বনিম্ন আটটি অক্ষর নির্বাচন করতে বলা হয়। কিন্তু চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কলাবাগান থানায় গিয়ে জিডি করতে বাধ্য হই।

এ সেবাগ্রহীতা বলেন, অনলাইন জিডি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটা সেবাগ্রহীতার জন্য সহজ ও স্বাধীন হওয়া উচিত। সহজতর না হলে এ উদ্যোগ কাজে আসবে না। অনলাইন জিডি অ্যাপসের দেখভালে জড়িত পুলিশ সদর দপ্তরের আইসিটি বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, দুই উপায়ে জিডি এন্ট্রি হচ্ছে। আমরা প্রচুর ফিডব্যাক পাচ্ছি। অনেকে নেগেটিভ মন্তব্যও করছেন। ব্যবহারে বিড়ম্বনার নেতিবাচক ফিডব্যাকও আসছে। আমরা সব ধরনের নেতিবাচক ফিডব্যাক ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। অ্যাপসটা ইউজার ফ্রেন্ডলি করার চেষ্টা চলছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) ওয়াই এম বেলালুর রহমান বলেন, অ্যাপসে অনলাইন জিডি এন্ট্রি করতে সমস্যা হচ্ছে— এমন অভিযোগ আমরা পেয়েছি। যেসব সেবাগ্রহীতা বিড়ম্বনার কথা আমাদের জানিয়েছেন তদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সমস্যা চিহ্নিত হলে সমাধানও আছে। আমরা ইউজার ও সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে আরও ফিডব্যাক আশা করছি। এখন পর্যন্ত যেসব সমস্যার বিষয় আমাদের নজরে এসেছে তা সমাধান করা হচ্ছে।

চলতি বছরে অনুষ্ঠিত পুলিশ সপ্তাহে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইজিপির বিশেষ সভায় অনেকগুলো সুপারিশ ও পরামর্শ উঠে আসে। সেখানে ময়মনসিংহ রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় থেকে দাবি উত্থাপন করা হয় যে শুধু হারানোর অভিযোগ নয়, এর সঙ্গে সীমিত পরিসরে হলেও ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও শিশু অপহরণের অভিযোগগুলোর কার্যক্রম চালু করা হোক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) ওয়াই এম বেলালুর রহমান বলেন, এটা আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে আছে। এখনও এটা বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি হয়নি। আগে অনলাইন জিডি কার্যক্রমটা শক্তিশালী করি। তারপর বাকিগুলো আমরা চালু করব। প্রথমে প্লে স্টোর থেকে ONLINE GD নামক সফটওয়্যার ইন্সটল করতে হবে। এরপর নিজের মোবাইল নম্বর এবং মনে রাখার মতো পাসওয়ার্ড দিয়ে বাকি নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। নির্ধারিত ছকের তথ্যগুলো পূরণ করে অনলাইন জিডির তথ্যাদি এন্ট্রি করতে হবে।

নিবন্ধন অপশনে গেলে মিলবে আরও চারটি অপশন। সেখানে আছে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, পাসপোর্ট ও বিদেশি পাসপোর্ট। তবে আপাতত জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যে নিবন্ধন করা যাচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের অপশনে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, জন্মতারিখ ও পরিচয়পত্র যাচাই করে ব্যবহারকারীর জেলা, থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম ও ঘটনার বিবরণ সংক্রান্ত তথ্যবিবরণী দিতে হবে।

অভিযোগ শেষ হলেই মিলবে সার্ভিস কোড: অনলাইনে জিডি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ব্যবহারকারী পাবেন সার্ভিস কোড। অল্প সময়ের মধ্যে অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে কিউ-আর কোড সম্বলিত জিডির কপি সংগ্রহ ও মুদ্রণ করা যাবে। সফটওয়্যার ছাড়াও অনলাইন জিডি করা যাবে GD.POLICE.GOV.BD- এই ঠিকানায়।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom