ব্যাপক সমালোচনার মুখে বিতর্কিত ‘সাইবার নিরাপত্তা’ আইন
ব্যাপক সমালোচনার মুখে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কিছু পরিবর্তন এনে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন একটি আইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: ব্যাপক সমালোচনার মুখে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কিছু পরিবর্তন এনে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন একটি আইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধিকাংশ ধারাই থাকছে নতুন আইনে। তবে জামিন অযোগ্য কয়েকটি ধারাকে করা হচ্ছে জামিনযোগ্য। এ ছাড়া মানহানি মামলায় কারাদ-ের বিধান বাদ দিয়ে রাখা হচ্ছে শুধু জরিমানার বিধান। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক ধারাগুলো রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হলে জনগণের হয়রানি থেকেই যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নতুন আইনেও মানুষের হয়রানি কমবে না। এই আইন চূড়ান্ত করার আগে অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপকভাবে আলোচনার প্রয়োজন ছিল। এ বিষয়ে মানবজমিন কয়েকজন বিশিষ্টজনের মতামত তুলে ধরে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার আগে সংসদীয় কমিটিতে আমরা কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ না করে আইনটি সংসদে পাস করা হয়। তখনই আমরা বলেছিলাম, আইনটি ত্রুটিপূর্ণ। কারণ, আমাদের অনেক দাবি সেটিতে মানা হয়নি। আমাদের মূলত উদ্বেগ ছিল চারটি জায়গায়। প্রথমটি ছিল প্রয়োগের ক্ষেত্রে। কারণ, আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যার ফলে এটির অব্যবহার ও অপপ্রয়োগের আশঙ্কা আছে। দ্বিতীয় উদ্বেগটি ছিল, এই আইনে অনেকগুলো ধারা আছে, যেগুলো অজামিনযোগ্য। আমরা বলেছিলাম, এগুলো জামিনযোগ্য করতে হবে। তৃতীয়টি হলো, আইনে শাস্তির মাত্রা অনেক বেশি, এটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা। আর চতুর্থটি হলো, আইনটি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রয়োগের আগে প্রাথমিক সত্যতা ঠিক করার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ ঠিক করা দরকার।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যাত্রাটি শুরু হয়েছিল আইসিটি আইন দিয়ে। ওই আইনের ৫৭ ধারার ব্যাপক অপপ্রয়োগ হয়েছিল। তখন আমরা বলেছিলাম, এই অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। তখন তারা বলেছিলেন, তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করছেন, তাতে ৫৭ ধারা আর থাকবে না। কিন্তু দেখা গেল ৫৭ ধারা অপসারণ করা হলোই না, বরং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়া হলো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে এরপর আমরা প্রতিবাদ করলাম যে, এই আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। তিনি বলেন, মাননীয় আইনমন্ত্রীও আইনের অপপ্রয়োগের কথা স্বীকার করে গতকাল বলেছেন, ‘এই আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার মামলা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরমধ্যে ১৫০টির মতো মামলা টিকেছে এবং সাংবাদিকসহ ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় বাকি মামলাগুলো সঠিক ছিল না। ভুয়া মামলা ছিল। তিনি বলেন, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশে একটি আইন থাকা দরকার। কিন্তু আইসিটি আইন বদলিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে আমাদের যেই জায়গায় ঠেলে দেয়া হয়েছিল, আবার যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করে আমাদেরকে ওই জায়গায় ঠেলে দেয়া হয়, তাহলে আমাদের আশঙ্কা থেকে যায় যে এটির অপপ্রয়োগ হতে পারে। অনেক হয়রানিমূলক ঘটনা ঘটতে পারে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন চূড়ান্ত করার আগে সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিকতার শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নেয়া প্রয়োজন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইন করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি যে এই আইনটি মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অগাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রজাতন্ত্রের মালিকদের বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার হরণ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে এটি হতে পারে না। এটার পরিবর্তন দরকার। নতুন আইনে যদি আগের ধারাগুলোই রাখা হয়, তাহলে পুরানো বোতলে নতুন পানীয় হবে। নতুন আইনে যদি আগের ধারাগুলোই রাখা হয় তাহলে মানুষের ভোগান্তি কমবে না। তিনি বলেন, সরকার যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করতে চায় তাহলে অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা করতে হবে। আলোচনা করতে হবে যে এমন একটি আইন আসলে আমাদের প্রয়োজন আছে কিনা। তিনি বলেন, নতুন আইনে যদি গুণগত পরিবর্তন না আসে, তাহলে মানুষ আগের মতোই হয়রানির স্বীকার হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, নীতি নির্ধারকদের মন্তব্য ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী এটি খুবই স্পষ্ট যে পুরানো আইনেরই দুই-একটি ধারা সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জনগণের সুরক্ষা যদি বিবেচনায় আনা হতো তাহলে আইন করার আগে জনগণের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা করার সুযোগ ছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জামিন অযোগ্য ধারা রয়ে গেছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া আছে। তারা ওয়ারেন্ট ছাড়াই মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে, আটক করতে পারেন এবং মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন জিনিস তল্লাশি করতে পারেন। ফলে এই মুহূর্তে যেটি বোঝা যাচ্ছে, সেটি হলো পুরানো আইনটি নতুন মোড়কে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে যে আইন করা হচ্ছে তাতে মানুষের হয়রানি কমবে না বলে জানিয়েছেন কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আইনমন্ত্রী বলেছেন- নতুন আইনে আগের ধারাগুলো থাকছে। শুধু সাজার পরিমাণ কিছুটা কমছে। ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে যে কাজ করা যেতো, সাইবার নিরাপত্তা আইন দিয়েও একই কাজ করা যাবে। এ ছাড়া আইনমন্ত্রীর কথা দ্বারা বোঝা যায় যে, উনারা ইতিমধ্যে নতুন আইনের খসড়া তৈরি করে ফেলেছেন। তাহলে খসড়া তৈরির আগে অংশীজনকে জানানো হলো না কেন? সরকারকে প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, নতুন আইনে আগের ধারাগুলোই যদি থাকে, তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হলো কেন? আইনের ধারাগুলো আগের মতোই থাকলে মানুষের হয়রানি কমবে না বলে জানান এই আইনজীবী।