ঋণখেলাপির মামলায় ধীরগতি

হলমার্ক নামের একটি কোম্পানি সোনালী ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করে।

ঋণখেলাপির মামলায় ধীরগতি

প্রথম নিউজ,ঢাকা: দেশের ইতিহাসে আর্থিক খাতে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে ২০১৩ সালে। হলমার্ক নামের একটি কোম্পানি সোনালী ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করে। ব্যাংক কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক ইন্ধনে হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় দুদকের পক্ষ থেকে প্রায় ৪০টি মামলা দায়ের করা হয়। বেশিরভাগ মামলার চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে আদালতে। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও রায় হয়েছে মাত্র দুটি মামলায়।

শুধু হলমার্ক নয়, আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারিসহ বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অনেক মামলারই তদন্ত ঝুলে আছে বছরের পর বছর। কয়েকটি মামলার তদন্ত শেষ হলেও শেষ হয়নি বিচার প্রক্রিয়া। জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে সীমিত পরিসরে আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। কিছুদিন আগে বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত আমরা আলোচিত সব মামলার শুনানি শুরু করতে পারবো।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বেশি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ভুয়া তথ্য নিয়ে ঋণের টাকা লোপাট করা, ওভার ইনভয়েস বা আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগসহ জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগেও মামলা হয়েছে। আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে তার চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে বিদেশে পাচারের অভিযোগে দুদক ৩৬টি মামলা দায়ের করেছে। এর মধ্যে মাত্র একটি মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলাগুলো তদন্তাধীন।

এরইমধ্যে পি কে হালদার ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরিয়েট- ইডির হাতে গ্রেফতার হলে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ভারতে তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় সেটিও ঝুলে আছে। দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, পি কে হালদারকে ফিরিয়ে আনতে পারলে তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর তথ্য আরও সমৃদ্ধ করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হবে। এজন্য তারা হালদারকে ফিরিয়ে আনা বা ভারতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।

দেশের আরেক বড় প্রতিষ্ঠান ক্রিসেন্ট গ্রুপ জনতা ব্যাংকে ভুয়া তথ্য দিয়ে প্রায় ৫ হাজার কোটি ঋণের নামে আত্মসাত করে। এই ঘটনায়ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের কর্ণধার এম এ কাদেরের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক। একাধিক মামলার মধ্যে মাত্র একটি মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে আদালতে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে জনতা ব্যাংক থেকে শুধু ক্রিসেন্ট গ্রুপই নয়, অ্যাননটেক্স ও থারম্যাক্স গ্রুপ মিলেও প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। দুদকের পক্ষ থেকে এসব ঘটনায় মামলা দায়ের হলেও কোনও মামলায় এখনও দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়নি। অ্যানন টেক্সের কর্ণধার ইউনুস বাদল আমদানির নামে কয়েক হাজার কোটি লোপাট করেছেন। তার বিরুদ্ধে আগে চোরাই-গাড়ি কেনাবেচার অভিযোগও ছিল।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ইউনুস বাদলকে একবার গ্রেফতারও করেছিল। এছাড়া বিসমিল্লাহ গ্রুপও জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাত করেছে। সূত্র জানায়, আলোচিত বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনারও প্রায় ১০ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। ২০১২ সালে বেসিক ব্যাংক থেকে খাদিজা অ্যান্ড সন্স, মেসার্স সিমেক্স লিমিটেডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জালিয়াতি করে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে।

এসব ঘটনায় ২০১৫ সালে ও পরে মোট ৫৬টি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে মাত্র দুটি মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে আদালতে। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘আলোচিত মামলাগুলোর শুনানির বিষয়ে দুদকও একমত। বেশ কিছুদিন ধরে মামলাগুলো পেন্ডিং হয়ে আছে। দ্রুত এসব মামলা শুনানির জন্য আদালতে তোলা হবে।’

চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতের পেশকার মো. রেজাউল করিম জানিয়েছেন, এ আদালতে ৪ হাজার ৯৯৪টি মামলা বিচারাধীন। নগরীর দেওয়ানহাট এলাকার মেসার্স আকতার এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার মোহাম্মদ নূর উন নবীর বিরুদ্ধে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের তিন মামলায় প্রায় ৫৫০ কোটি টাকার মামলা বিচারাধীন। এ টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করায় এসব মামলা দায়ের হয়।

এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক হালিশহর শাখায় ১৫০ কোটি টাকা, একই ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ২০০ কোটি টাকা এবং তার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা অপর একটি মামলায় ১২৮ কোটি ৩১ লাখ টাকার মামলা বিচারাধীন। চট্টগ্রামের বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীরের বিভিন্ন ব্যাংকের ১২৭ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৫৫ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৪৬ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার ১২ কোটি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১৫ কোটি টাকা।

সিটি ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ১৭ কোটি ৩ হাজার টাকা ঋণ নেন ফেরদৌস খান আলমগীর। এ টাকা আদায়ে ২০১২ সালে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে ব্যাংকটি। সিটি ব্যাংকের করা মামলায় গত বছরের ৩ নভেম্বর গ্রেফতার হন তিনি। তার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে ১০টিরও বেশি মামলায় রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাইম ব্যাংকের লালদিঘী পাড় শাখা থেকে ৩১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনি ন্যাশনাল আয়রনের মালিক হারুনুর রশিদ। তার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাদি হয়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। একই ব্যক্তি অপর একটি প্রতিষ্ঠান রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল-এর নামে একই ব্যাংক থেকে ৩৯ কোটি টাকা ঋণ নেন। ঋণ পরিশোধ না করায় ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাদি হয়ে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলা দুটি বর্তমানে সাক্ষী পর্যায়ে রয়েছে।

সূত্র জানায়, প্রাইম ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে নেম করপোরেশনের মালিক আবদুল আলিম চৌধুরী ৩৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। ঋণের ওই টাকা পরিশোধ না করায় ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। প্রাইম ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে ১৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন নিশাত স্টিল মিল-এর মালিক মো. জাফর উল্লাহ। ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় ২০১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ টাকা আদায়ে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি এখন সাক্ষী পর্যায়ে রয়েছে।

এম অ্যান্ড জেড করপোরেশন-এর মালিক সৈয়দ জুনায়েদুল হক প্রাইম ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ৫৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেননি। টাকা আদায়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সালে মামলা দায়ের করে। সেটাও সাক্ষী পর্যায়ে রয়েছে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom