আর কোনো নিষেধাজ্ঞা না চাওয়ার বার্তা যুক্তরাষ্ট্রকে দেবে বাংলাদেশ

দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ এ বিষয় তোলার কথা ভাবছে

আর কোনো নিষেধাজ্ঞা না চাওয়ার বার্তা যুক্তরাষ্ট্রকে দেবে বাংলাদেশ
আর কোনো নিষেধাজ্ঞা না চাওয়ার বার্তা যুক্তরাষ্ট্রকে দেবে বাংলাদেশ

প্রথম নিউজ, অনলাইন : গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে প্রায় দেড় বছর আগে র‌্যাব ও এই বাহিনীর সাত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে নানা স্তরে চেষ্টার পরও তা   বলবৎ আছে। এ নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তির কারণ তৈরি করেছে। নতুন করে যাতে এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা না হয় যুক্তরাষ্ট্রকে সেই অনুরোধ জানাবে বাংলাদেশ। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ এ বিষয় তোলার কথা ভাবছে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক একাধিক সূত্র গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

ভারত সফর শেষ করে দুই দিনের সফরে ডোনাল্ড লুর আগামীকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে। রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথা রয়েছে তাঁর। এছাড়া পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে তাঁর দেখা হতে পারে। সরকারি পর্যায়ে এসব আলোচনার পাশাপাশি লু বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানান, ডোনাল্ড লুর সফরে দুই পক্ষের সম্পর্কের বিভিন্ন দিক আলোচনায় আসতে পারে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের অগ্রাধিকার এবং উদ্বেগের বিষয়গুলো তুলবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে র‌্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা ফিরিয়ে দেওয়া, ব্যবসা ও বাণিজ্য বাড়ানোর পাশাপাশি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শ্রম অধিকার এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় সরকারের নানা উদ্যোগ, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত নেওয়া নানা পদক্ষেপ, ভিয়েনা সনদ অনুযায়ী কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার বিষয় আলোচনায় তোলার কথা রয়েছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল, নির্বাচন ও গণতন্ত্র, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে আকসা ও জিসোমিয়ার মতো চুক্তিগুলো সই করা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং প্রস্তাবিত ডাটা সুরক্ষা আইন বিষয়ে তাদের ভিন্নমতের বিষয়গুলো তুলে ধরা হতে পারে।

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রসঙ্গ টেনে একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, গত ৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার এডমিরাল এইলিন লুবাখারের সঙ্গে বৈঠকে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বিশেষায়িত বাহিনীটি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে সফল হয়েছে। র‌্যাবের কর্মকাণ্ড পরিচালনার সময় কখনো কখনো নিয়মের ব্যত্যয় হয়তো ঘটেছে। কিন্তু এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা অন্যান্য বাহিনী ও সংস্থার কর্মকাণ্ড পরিচালনায় নিরুৎসাহিত করে। আবার সামগ্রিকভাবে তা দেশের ভাবমূর্তির জন্য সংকট তৈরি করে। সরাসরি না হলেও এ আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সামনের দিনগুলোতে এমন ধরনের কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ওয়াশিংটনের দিক থেকে আসবে না—এমনটা প্রত্যাশা করে ঢাকা।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘গতবছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনা ও সফরের বেশ কিছু ইতিবাচক ফল এসেছে। যেসব জায়গায় সমস্যা আছে সেসব গুরুত্বের সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা আমাদের আছে। নিষেধাজ্ঞার পর থেকে র‌্যাবের প্রসঙ্গটি আমরা সব আলোচনায় তুলে আসছি। এবারও এ বিষয় তুলব।’ তিনি বলেন, ‘এছাড়া জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেওয়া, ব্যবসা–বাণিজ্য বাড়ানো, শ্রম ইস্যুতে কীভাবে একসঙ্গে কাজ করা যায় ইত্যাদি তুলব। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর মতো অমিমাংসিত বিষয়গুলো আমরা তুলব।’

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি বিদেশি মিশন প্রধানদের কাছে লেখা চিঠিতে পররাষ্ট্রসচিব নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিস্থিতি হলে তিনি তা প্রতিরোধ করার কথাও উল্লেখ করেছেন।

ডোনাল্ড লুর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমাদের কাজই হচ্ছে এ ধরনের (নিষেধাজ্ঞা) বিষয়গুলো সুরাহা করা। কাজেই আগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে একই ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়তে না হয়, সেটিও উল্লেখ করা হতে পারে।’

বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা চলতি মাসে রিয়ার এডমিরাল এইলিন লুবাখার ও ডোনাল্ড লুর সফরকে সামগ্রিক সম্পর্কের আলোকেই দেখছেন। গত বছর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আসবে কি না তা নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ ছিল। এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আর বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেসব মতপার্থক্য ও উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের আছে তা দূর করার চেষ্টাও চলছে।

এইলিন লুবাখারের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘দুই পক্ষেরই অনেক কিছু বলার আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আমরা যে প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি সেই পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। যেকোনো দেশের সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন থাকতে পারে। আমিও মনে করি, দুই দেশের সম্পর্ক ও অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারাবাহিকতার ধারা থেকে আমাদের বিচ্যুত হওয়া যাবে না।’

চলতি মাসে বাংলাদেশ সফরকারী যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হতে চলেছেন ডোনাল্ড লু। গত সপ্তাহে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক এইলিন লুবাখার চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এ মাসের শেষে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলের বাংলাদেশ সফরের কথা ছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেনের বিশেষ এ উপদেষ্টা এখন ফেব্রুয়ারিতে আসতে পারেন।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ সাঈদ ফয়সাল নিহত হওয়ার ঘটনার বিচারের দাবিতে রাজনীতিবিদ ও সমাজের নানা স্তরের লোকজন মার্কিন প্রশাসনের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন।

এ বিষয় দুই দেশের সম্পর্কে কতটা প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। সাঈদ ফয়সালের নিহত হওয়ার বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। এ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাদের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে পারি। যুক্তরাষ্ট্র ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্তের বিষয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছে। আমরা এ নিয়ে প্রতিবেদন চাইব। তবে আমরা চাই, এমন কিছু যাতে করা না হয়, যাতে সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: