প্রথম নিউজ, চট্টগ্রাম: চলতি মাসের শুরুতেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ভর্তুকি কমাতে ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে দাম। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরপরই বাসভাড়াসহ একে একে দাম বাড়তে থাকে সব ধরনের নিত্যপণ্যের। মানুষের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। চাপে আছে বিপিসি।
এরই মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের চাহিদা নিয়ে নতুন মাথাব্যথা শুরু হয়েছে রাষ্ট্রীয় পেট্রোলিয়াম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানটির। গত বছরের (২০২১ সালের) আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসে ৪২ হাজার টন ডিজেলের চাহিদা দিয়েছিল পিডিবি। সেখানে চলতি বছর একই সময়ের জন্য ৩ লাখ ৯১ হাজার টন ডিজেলের চাহিদা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৩১ শতাংশ বেশি।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর ৬৫ টাকার ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। নয় মাসের মাথায় গত ৫ আগস্ট আবার ৩৪ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ১১৪ টাকা। একই আদেশে পেট্রলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়। এর আগে পেট্রলের দাম ছিল ৮৬ ও অকটেন ছিল ৮৯ টাকা।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির তিনদিনের মাথায় ৮ আগস্ট পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বিপিসিকে ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের চাহিদা পাঠানো হয়। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মাসওয়ারি ওই চাহিদাপত্রে দেখা যায়, এই তিন মাসের জন্য ডিজেলের চাহিদা দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ৯১ হাজার ১০০ টন। এ সময়ে ফার্নেস অয়েলের চাহিদা দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার ৯০০ টন। এরমধ্যে আগস্ট মাসেই ডিজেলের চাহিদা দেওয়া হয়েছে এক লাখ ৫৪ হাজার ৩০০ টন। আগস্টে ফার্নেস অয়েলের চাহিদা দেওয়া হয়েছে এক লাখ ৭ হাজার ৪০০ টন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসের জন্য ডিজেলের চাহিদা ছিল ৪২ হাজার টন। ওই সময়ে ফার্নেস অয়েলের চাহিদা ছিল এক লাখ ৪৬ হাজার টন। এখন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এছাড়া ডিজেলের চাহিদা বেড়েছে ৯ গুণেরও বেশি।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে দেশে ১৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৫৫টি ইউনিট রয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ২১ হাজার ৬৮০ মেগাওয়াট। ১৭ আগস্ট পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৫২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এগুলোর মধ্যে গ্যাসনির্ভর ৫৭টি, ফার্নেস অয়েলনির্ভর ৫৬টি, ডিজেলনির্ভর ১১টি, কয়লানির্ভর ৩টি, একটি হাইড্রো (পানিবিদ্যুৎ) এবং তিনটি সোলার বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্রও রয়েছে। দেশে মোট উৎপাদনের ৫১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে গ্যাসনির্ভর প্ল্যান্ট থেকে। ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে ফার্নেস অয়েলনির্ভর প্ল্যান্ট থেকে। এছাড়া ডিজেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসে ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ বিদ্যুৎ। কিন্তু গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্রও রয়েছে। বর্তমানে গ্যাসের সংকট থাকায় ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ডিজেল এবং ফার্নেস অয়েল দিয়ে চালানোর পরিকল্পনা নিয়েছে পিডিবি।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে বর্তমানে ফার্নেস অয়েলনির্ভর ৫৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাসে ফার্নেস অয়েলের চাহিদা ৬০ হাজার টন। ২০১৪ সাল থেকে ফার্নেস অয়েল আমদানি শুরু করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এরপর বেসরকারি প্ল্যান্টগুলোকে (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট- আইপিপি) ফার্নেস অয়েল সরবরাহ বন্ধ করে দেয় বিপিসি। আইপিপিগুলোকে আমদানির সুযোগ দেওয়া হলেও শর্ত ছিল ১০-১২ শতাংশ ফার্নেস অয়েল বিপিসি থেকে নিতে হবে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কম থাকায় চুক্তির শর্ত মোতাবেক চাহিদার ১০-২০ শতাংশ জ্বালানি বিপিসি থেকে নেয়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে আইপিপিগুলো সেই শর্ত কাজে লাগিয়ে বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল নেওয়া শুরু করে। এর ওপর গ্যাস সংকটের কারণে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ফলে বিপিসির কাছে চাহিদাও বাড়িয়েছে পিডিবি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবির সচিব মো. সেলিম রেজা বলেন, আমাদের কাছে বিপিসিকে চিঠি দেওয়ার নোট এসেছে। সে অনুযায়ী বিপিসিকে চিঠি দিয়েছি। কেন বেড়েছে, সেটা কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স কিংবা জেনারেশন বিভাগ বলতে পারবে।
পিডিবির বোর্ড সদস্য (কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স) মো. নাজমুল হক বুধবার (১৭ আগস্ট) সন্ধ্যায় বলেন, এখন গ্যাসের সংকট রয়েছে। পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহ করতে পারছেন না। এ কারণে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের চাহিদা বেড়েছে। আবার প্রতিনিয়ত বিদ্যুতের লোডও বাড়ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণগুলোর চাহিদা বাড়ছে। তবে পিডিবির চাহিদাপত্র দেওয়ার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল সরবরাহে অগ্রাধিকার দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিপিসিকে। এ বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত সচিব ও বিপিসির পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) খালিদ আহম্মেদের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে মোবাইল এবং হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পিডিবি থেকে মাত্র কয়েকদিন আগে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। অথচ আগস্ট মাসের চাহিদাও ছিল ওই চাহিদাপত্রে। আগস্ট মাসেই ডিজেলের চাহিদা দেওয়া হয়েছে দেড় লাখ টনের বেশি। ফার্নেস অয়েলের চাহিদা দেওয়া হয়েছে এক লাখ টনের বেশি।
তিনি বলেন, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল চাইলেই তো পাওয়া যায় না। এগুলো আমাদের আমদানি করে আনতে হয়। পেট্রলিয়াম জ্বালানি আমদানির জন্য ছয় মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। পিডিবির আগের চাহিদা পর্যালোচনা করে বিপিসি তাদের জন্য আগাম জ্বালানি আমদানি করে। কিন্তু এবার ডিজেলের চাহিদা দেওয়া হয়েছে ৯ গুণের বেশি। সেখানে তাৎক্ষণিক এত বড় পরিমাণের ডিজেল সরবরাহ দেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য।