সামনে কঠিন সংকট উত্তরণের উপায় কী?

সামনে কঠিন সংকট উত্তরণের উপায় কী?


প্রথম নিউজ, অনলাইন:বাংলাদেশের সামনে কঠিন সংকট অপেক্ষামান। এই সংকটের মূলেই অর্থনীতি। অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার জন্য দায়ী রাজনীতি এবং নির্বাচন। বস্তুত  রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না ছাড়া অর্থনীতির সংকট দূরীভূত হয় না। 

দিনদিন অর্থনীতির আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে, উৎপাদন কমে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে না কর্মসংস্থান। মানুষ দুর্দিনের ভয়ে ভীত। জিনিসপত্রের লাগামছাড়া দামে অতিষ্ঠ। রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ছাড়াও রাজস্ব ও ব্যাংক খাত নিয়ে ভয়াবহ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণেও ডলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ব্যাংকগুলোর বেশীরভাগই টিকে আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা নিয়ে।

আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ  ১৬ বিলিয়ন ডলার। আর রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি নেই। বাজারে ডলার সংকটে অস্থির অর্থনীতি। ২০০৯ সালে জনগনের ঘাড়ে থাকা ২৩.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ থেকে বিগত ১৫ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ বিলিয়নে। আইএমএফসহ অন্যকিছু দাতা সংস্থা যে ঋণ দিয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যতসামান্যই। জানুয়ারিতে আকুর পেমেন্ট দিতে হবে ১ বিলিয়ন ডলার, মেগাপ্রকল্পের কিস্তি আছে আরো ৫ বিলিয়ন ডলার। আবার মাসে রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যয় আছে ১ বিলিয়ন ডলারের মতো। অন্ধকার, পথহারা, অনিশ্চিত গন্তব্যের এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী? 

গত ৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, "তারা (বিএনপি) এত দিন বলেছে নির্বাচন হতে দেবে না। এখন যখন মনে করছে নির্বাচন হয়ে যাবে; তাহলে কী করা যাবে? আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের দিকে বাংলাদেশে এমন অবস্থা করবে, দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। এটা হচ্ছে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা। এটা শুধু দেশের না, বিদেশি একটা প্ররোচনাও আছে। যেভাবেই হোক দুর্ভিক্ষ ঘটাতে হবে।"

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে লাল-সবুজ পতাকার বাংলাদেশের জন্ম হয়। এ দেশ সৃষ্টির পরপরই ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরের ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে, অর্ধহারে মারা গিয়েছিল। সরকারি হিসাব অনুসারে ২৭ হাজার মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। বেসরকারি হিসেবে অনুমানিক ১ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ  প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মৃত্যুবরণ করে। এই দুর্ভিক্ষকে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গণ্য করা হয়।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ কেন এবং কিভাবে হয়েছিলো, তার দীর্ঘ গবেষণার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন অর্থনীতির নোবেল জয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। দেশের ভীতরের সংকটের পাশাপাশি কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য শুরুর শাস্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তার খাদ্যসহায়তা স্থগিত করায় সংকটের মাত্রা যে বেড়ে গিয়েছিল, সে কথাও তার রচনায় উল্লেখ আছে।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন হচ্ছে, সেটির ফলাফল তো পূর্বনির্ধারিত। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন শর্তহীন সংলাপের আহবান জানিয়েছিলো। কিন্তু সেই আহবান অগ্রহ্য করেই নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হয়। যে নির্বাচনে সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ তার মিত্ররা বয়কট করেছে। চলতি বছরের ২৪ মে বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার লক্ষ্যে ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোটের পর ভিসানীতি ঘোষণা করা হলেও কেবলমাত্র বাংলাদেশে তফশিলের অনেক আগেই ঘোষণা করা হয়েছে। নীতি ঘোষণার পর গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্থদের বিরুদ্ধে ভিসানীতি কার্যকর হয়। ভিসা নীতিতে জনগণের কার্যত তেমন কষ্ট হয়নি।  প্রত্যক্ষভাবে জনগনের উপর প্রভাব ফেলেনি। তবে এবার বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার মতো বড় পদক্ষেপের খেসারত দিতে হতে পারে জনগণকে। কেননা বিশ্বজুড়ে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা, শ্রমিক অধিকারের পক্ষের কর্মী, শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে যে বা যারা হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করবে তাদেরকে জবাবদিহিতায় নেবে যুক্তরাষ্ট্র। 

সেখানে বলা হয়েছে যারা শ্রমিকদের নিপীড়ন করবে, তাদের বিরুদ্ধে ভিসা বিধিনিষেধ, বাণিজ্যিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত ১৬ নভেম্বর প্রথমবারের মতো এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এই নতুন নীতি অনুমোদনের কিছুদিন আগে বাংলাদেশেও চলছে শ্রমিক আন্দোলন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে চারজন শ্রমিকের মৃত্যুও হয়। এই নীতি ঘোষণার প্রসঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশি গার্মেন্ট শ্রমিক ও অধিকারকর্মী কল্পনা আক্তারের মতো মানুষদের চাই। তিনি বেঁচে আছেন কারণ তার পক্ষে কথা বলেছে মার্কিন দূতাবাস। যখন আমরা আমাদের কণ্ঠস্বরকে, আমাদের এডভোকেসিকে ব্যবহার করি, তখন যারা শ্রম অধিকার নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তাদের সুরক্ষিত ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমাদের উদ্যোগ বড় ব্যবধান তৈরি করতে পারে।’

সামনের দফায় যদি যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়, বর্তমানে ঝুঁকিতে থাকা অর্থনীতির করুন পরিণতি হতে পারে। কারণ বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যে গার্মেন্টেসের গন্তব্য পশ্চিমাবিশ্বে। বিকল্প মার্কেট তৈরি হয়নি। এছাড়া বাংলাদেশিদের বসবাস, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা, ব্যবসা-বিনিয়োগ ও টাকা পাচারের কেন্দ্রও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে যথেষ্ট অস্বস্তিতে রয়েছে পশ্চিমারা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তার জয়-পরাজয় মোটামুটি পূর্বনির্ধারিত। নির্বাচন সরকার পরিবর্তনের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। সংবিধান অনুযায়ী শুধুমাত্র শাসনতন্ত্রকে বৈধতার নির্বাচন। নির্বাচিতদের গেজেট প্রকাশের আনুষ্ঠানিকতা বাকি। যেটি ঠিক পশ্চিমা মডেলের উল্টা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। যে নির্বাচনটি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি কিংবা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ধারাবাহিকতার আরেকটি নতুন  রুপমাত্র। 

শ্রম অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ঘোষণার পর সম্প্রতি পোশাক মালিকরা বলছেন, বাংলাদেশে পোশাক খাতের শ্রম পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায়নি, যেজন্য যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোন দেশ নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। বরং নিষেধাজ্ঞা আসলে সেটা হতে পারে রাজনৈতিক কারণেই। অতএব রাজনৈতিক সংকট অর্থনীতিকে বিপদাপন্ন করেছে। সাজানো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মী জেলে। সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। সরকারি দলের কোন প্রতিপক্ষই নেই। যেসব দলের নিয়ে ভোট হচ্ছে সেইগুলো সবই আওয়ামী লীগ, সমমনা বা কিংস পার্টি। 

ভোটের এই পরিস্থিতিতে আসন্ন ৭ জানুয়ারির নির্বাচন কি সংকটাপন্ন অর্থনীতির এই মহাদুরাবস্থা থেকে জনগনকে মুক্তি দিতে পারবে? নাকি সংকটকে আরো বাড়ি দেবে? জীবনযাত্রার কোন পরিবর্তন হবে? চলমান ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কি অবসান ঘটবে? অর্থনীতির মহাবিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে? যে নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতির এই দুরাবস্থা হলো, সেই রাজনৈতিক সরকার বা নেতৃত্ব দিয়েই কি রাতারাতি সংকট উত্তরণ সম্ভব? দৃশ্যত নির্বাচনের নৈতিক মানদণ্ডে 'দুর্বল' সরকারের পক্ষে কাজগুলো বেশ কঠিন হবে। তাহলে বাংলাদেশ কি সত্যি সত্যি ১৯৭৪ সালের মতো আরেকটি দুর্ভিক্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছে? 

লেখক : সাইদুর রহমান, সভাপতি, রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন এন্ড ডেমোক্রসি (আরএফইডি) এবং সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক।