স্বামীর লাশ নিতে মেয়েকে নিয়ে মর্গে সাজনা
এ ঘটনায় রেলওয়ে থানায় মামলা হলেও এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। অগ্নিকাণ্ডের তথ্য নিয়েও মামলার বাদী ও তদন্ত সংশ্লিষ্টদের তথ্যে গরমিল রয়েছে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ডের রহস্য এখনো উদ্ঘাটন হয়নি। এ ঘটনায় রেলওয়ে থানায় মামলা হলেও এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। অগ্নিকাণ্ডের তথ্য নিয়েও মামলার বাদী ও তদন্ত সংশ্লিষ্টদের তথ্যে গরমিল রয়েছে। মামলার এজাহারে বাদী বলেছেন, রাত ১১টায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি মোহনগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে এসে ভোর ৪টা ৩৭ মিনিটে বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছানোর পর তিন মিনিটের যাত্রা বিরতি করে। ৪টা ৪০ মিনিটে বিমানবন্দর থেকে ছাড়ার তিন মিনিট পর ট্রেনটিতে আগুন লাগে। এই সময়ে ট্রেনটি খিলক্ষেত পর্যন্ত যাওয়াই সম্ভব নয়। অথচ মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তারা একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন ট্রেনটি ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন অতিক্রম করার পরও আগুনের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। এরপরে যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় বলে তাদের ধারণা। ক্যান্টনমেন্টের পরে রেললাইনের আশপাশে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ চলার কারণে সিসি ক্যামেরার ফুটেজও পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া যেসব স্থাপনায় সিসি ক্যামেরা আছে সেগুলো রেললাইনমুখী না।
তবে বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে আসার ১৮ মিনিটের মাথায় ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে এসে পৌঁছায়। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, স্পর্শকাতর ঘটনাটির তদন্ত সব সংস্থাই খুব গুরুত্ব দিয়ে করছে। এদিকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কিছু প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যেসব বগিতে আগুন লেগেছে সেসব বগির দায়িত্বে থাকা রেলওয়ে স্টাফরা কেন তাৎক্ষণিক চালককে বা ট্রেন পরিচালককে জানাননি। বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত আসতে ট্রেনটি সময় নিয়েছে ১৮ মিনিট। অগ্নিকাণ্ড ঘটার পরপরই যদি চালককে জানানো হতো তাহলে হয়তো ৪ জনের প্রাণহানি না হতে পারতো। বগিতে থাকা স্টাফরা জানিয়েছেন তাদের কাছে পরিচালক বা চালকের মোবাইল নম্বর ছিল না। কেন ছিল না সে বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে বা কীভাবে হয়েছে সে বিষয়টিও এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
মামলায় যা বলেছেন বাদী: ঢাকা রেলওয়ে থানায় করা মামলায় বাদী ট্রেন পরিচালক খালেদ মোশারফ উল্লেখ করেছেন, ১৮ই ডিসেম্বর রাত ১১টার সময় ঢাকাগামী ৭৯০ মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি মোহনগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে। ১৯শে ডিসেম্বর ভোররাত আনুমানিক ৪টা ৩৭ মিনিটে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে এসে ৩ মিনিট যাত্রা বিরতি করে ভোররাত ৪টা ৪০ মিনিটে ট্রেনটি বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে আসে। তার ৩ মিনিট পর ৪টা ৪৩ মিনিটের সময় ট্রেনের কোচ নং-ডব্লিউইসি-২৩৪১ এর-জ-বগি এবং কোচ নং ডব্লিউইসি-২৩১২-ঝ-বগির মাঝামাঝি অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীরা দাহ্য পদার্থ দ্বারা আগুন ধরিয়ে দেয়। হঠাৎ ট্রেনের বগির ভিতর ধোঁয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলে উক্ত বগিতে থাকা যাত্রীগণ চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। এরইমধ্যে ঝ ও জ বগিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। জ বগিতে কর্তব্যরত স্টুয়ার্ড মো. মাঈন উদ্দিন মানিক বিষয়টি টের পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে স্টুয়ার্ড ম্যানেজার রাহাত মিয়াকে জানান। স্টুয়ার্ড ম্যানেজার রাহাত মিয়া ট্রেনে আগুন লাগার বিষয়টি আমাকে জানান। কিন্তু তার আগেই ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে প্রবেশ কালে আমি ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে সিগন্যাল দেখার উদ্দেশ্যে সামনের দিকে তাকিয়ে অন্ধকার ও বগির ভিতর হতে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া বের হতে দেখি। ট্রেনে ধোঁয়া দেখে আমি এয়ার প্রেসার ড্রপ করে মুঠোফোনে উক্ত ট্রেনের এলএম দীলিপ কুমার ম-লের সঙ্গে যোগাযোগ করে ট্রেনটি ভোররাত অনুমানিক ৪টা ৫৮ মিনিটে দাঁড় করাতে সক্ষম হই এবং তাৎক্ষণিক বিষয়টি আমার ঊর্ধ্বতনদের জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের প্রয়োজন আছে বলে জানাই।
এজাহারে তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে ট্রেনের জ, ঝ ও ছ বগিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত রেলওয়ের সকল স্টাফ মিলে আগুন লাগা উক্ত বগি ৩টি বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের ১টি ইউনিট এবং পরে আরও ২টি ইউনিটসহ মোট ৩টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়। ফায়ার সার্ভিস রেলওয়ে পুলিশ, আরএনবি, ডিএমপি পুলিশসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজনের সহায়তায় ভোররাত ৫টা ৫০ মিনিটে উক্ত ট্রেনের ৩টি বগির আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
ওদিকে ঘটনার তদন্ত কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগেই মামলার এজাহারে ঘটনাটিকে নাশকতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া দুষ্কৃৃতিকারীরা পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে নাশকতা করে ট্রেনের যাত্রীদের হত্যা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগে এজাহারের এমন বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
নিহত সবার মরদেহ হস্তান্তর: মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ডে নিহত চারজনেরই মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল নিহত খোকন মিয়া (৩৪) ও বিএনপি নেতা রশীদ ঢালীর (৬০) মরদেহ গ্রহণ করেছে তাদের পরিবার। ময়নাতদন্ত শেষে বিকাল তিনটার দিকে খোকন মিয়ার মরদেহ তার স্ত্রী সাজনের কাছে এবং সাড়ে তিনটার দিকে রশীদ ঢালীর মরদেহ তার ছেলে মামুনের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। নিহত রশীদ ঢালীর ভাতিজা মো. বেলাল আহমেদ বলেন, আমি খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে এসে চাচার মরদেহ শনাক্ত করি। কোমরে তাবিজ, হাতে আংটি, গায়ের পোশাক দেখে চাচাকে চিনতে পারি। পরে তার ছেলে মামুন এসেও চাচার মরদেহ শনাক্ত করে। ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ আমাদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করেছে। এখান থেকে মরদেহ নেত্রকোনা সদরে নিয়ে যাবো। খোকনের স্ত্রী সাজনা বলেন, ভাতিজির বিয়ের জন্য আমার শাশুড়ি ও আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে বৃহস্পতিবার সে গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জে যায়। পরে গতকাল রাতে ট্রেনে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে। এরপর সোমবার রাত ৯টার পর তার সঙ্গে আর আমার কোনো কথা হয়নি। পরে জানতে পারলাম ট্রেনে আগুন লেগে চারজন মারা গেছেন। কিন্তু আমি আমার স্বামীর মোবাইলে অনেকবার ফোন দিয়েছি, কিন্তু কল যায়নি। পরে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে এসে দু’টি মরদেহ দেখি। এর মধ্যে একটি মরদেহে পাঞ্জাবি পরা, দাঁতে দাগের চিহ্ন ও মুখম-ল দেখে আমার স্বামীকে চিনতে পেরেছি। এখন মরদেহ নিয়ে সুনামগঞ্জে যাবো। সেখানে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে। স্বজনরা বলেন, খোকন মিয়ার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলায়। বৃদ্ধ মা বকুল আক্তার, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন নারায়ণগঞ্জে। তিনি কাজ করতেন একটি পোশাক কারখানায়। তার স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন নারায়ণগঞ্জে। তার স্ত্রী সাজনা আক্তারও একই কারখানায় কাজ করেন। গ্রামে খোকন মিয়ার কোনো জমিজমা নেই। আগে অন্যের জমিতে চাষাবাদ করতেন। পরে জীবিকার তাগিদে গ্রাম থেকে শহরে আসেন। তার বাবা নূর ইসলাম মারা গেছেন। মা বকুল আক্তার তার সঙ্গেই থাকতেন। কমলাপুর রেলওয়ে পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) সেতাফুর রহমান জানান, দুই পরিবারের স্বজনরা লাশ শনাক্ত করার পরে আমরা দুই পরিবারের কাছে ময়নাতদন্ত শেষে হস্তান্তর করেছি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার বলেছেন, অগ্নিসংযোগকারীরা পশু। তাদেরকে কোনো অবস্থাতে ছাড় দেয়া হবে না। গতকাল নিজ কার্যালয়ে তিনি আরও বলেন, এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে যে পার পাওয়া যাবে না, ডিএমপি সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।