সুনামগঞ্জে ১০ টাকার চালে কোটি টাকার দুর্নীতি

অভিযোগ উঠেছে গুদামে মজুত থাকা সিদ্ধ চাল বেশি দামে বিক্রি করে কম দামে বাজার থেকে আতপ চাল কিনে সেটি ডিলারদের কাছে দেয়া হয়।

সুনামগঞ্জে ১০ টাকার চালে কোটি টাকার দুর্নীতি
সুনামগঞ্জে ১০ টাকার চালে কোটি টাকার দুর্নীতি

প্রথম নিউজ, সুনামগঞ্জ: প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত কর্মসূচি হচ্ছে ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’। সেটি হচ্ছে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করা। যদিও বাজার দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এখন সেটি ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খাদ্য ভাণ্ডার বলে পরিচিত সুনামগঞ্জ। জেলা সদরের মল্লিকপুরে এই খাদ্যবান্ধব চাল নিয়ে আলোচনা এসেছে। মজুত নেই আতপ চালের। অথচ ডিলারদের কাছে দেয়া হয়েছে এই চাল। অভিযোগ উঠেছে গুদামে মজুত থাকা সিদ্ধ চাল বেশি দামে বিক্রি করে কম দামে বাজার থেকে আতপ চাল কিনে সেটি ডিলারদের কাছে দেয়া হয়। আর মাঝখানে লুটে নেয়া হয়েছে কোটি টাকা। খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ূমের দিকেই অভিযোগের তীর। কাগজপত্র ঘেঁটে জানা গেছে- চলতি সপ্তাহে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির জন্য ডিলারদের কাছে ৩৯৩  টন আতপ চাল দেয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার থেকে উপজেলার ইউনিয়নের ডিলাররা ওই চাল বিক্রি শুরু করেন। 

যে চাল বিক্রি করা হচ্ছে সেটি বর্তমান বাজারমূল্য ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। কিন্তু মল্লিকপুর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ূমের কাছে এত আতপ চাল মজুত ছিল না। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সপ্তাহের হিসাব মতে ১০ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মল্লিকপুর খাদ্য গুদামে ৪০ টন আতপ চাল মজুত ছিল। পরের সপ্তাহে ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসেবে মজুত দেখানো হয়েছে ৩৮ টন। এতে দেখা গেছে এক সপ্তাহে মাত্র দুই টন আতপ চাল গুদামের বাইরে গেছে। অথচ খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে বিতরণ করা হয়েছে ৩৯৩ টন আতপ চাল। আতপ চালের উৎস সম্পর্ক বলতে গিয়ে মল্লিকপুর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অন্য কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত চাল বলে স্বীকার করলেও বাস্তবে তিনি কোনো সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেনি। তার দেয়া গুঁজামিল তথ্যে যে হিসাব দেয়া হচ্ছে; সেটিও ৩৯৩ টন আতপ চালের উপরের সংখ্যা নয়। খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মানবজমিনকে জানিয়েছেন- মল্লিকপুর খাদ্য গুদামে থাকা সিদ্ধ চাল উন্নতমানের।

 সেটির বাজার মূল্য হচ্ছে কেজি প্রতি ৫০ থেকে ৫২ টাকা। সেই চাল খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কালোবাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করেন। পরে তিনি ওই টাকার একাংশ দিয়ে ৩০-৩৫ টাকা কেজি প্রতি আতপ চাল কিনে ডিলারদের কাছে দেন। আর ওই ডিলাররা এখন বাজারে ক্রয় করা আতপ চালই বিক্রি করছেন। হিসাব বলছে; ৪০০ টন আতপ চাল প্রতি টন ৩০ হাজার কিনলে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখে। আর ৪০০ টন সিদ্ধ চাল প্রতি টন ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করলে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি টাকা। এতে দেখা গেছে; খাদ্য গুদামের ওই কর্মকর্তা এক উপজেলার এক সপ্তাহের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চালে ৮০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কাগুজের হিসাব ও বাজারে আতপ চাল বিক্রির গরমিলের বিষয়টি গতকাল জানার পর সুনামগঞ্জে তোলপাড় শুরু হয়। এদিকে- সকালে সুনামগঞ্জ উপজেলা সদরের গোরারঙ্গপুরের ডিলার মনির উদ্দিন, ইসলামগঞ্জের ডিলার সুজন নন্দিসহ কয়েকজন ডিলারের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে- খাদ্যবান্ধব ওই কর্মসূচির আতপ চালই বিক্রি হচ্ছে। ডিলাররা জানিয়েছেন- তারা আতপ চাল পেয়েছেন। এজন্য বিক্রি করছেন। সুরমা ইউনিয়নের ডিলার ও উপজেলা ডিলার সমিতির সভাপতি এরন মিয়া জানিয়েছেন- আতপ চাল পাওয়ায় তারা আতপ চালই বিক্রি করছেন। 

অন্য চাল পেলে সেগুলো সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করে থাকেন। বিক্রিতে কোনো ধরনের গরমিল হয় না বলে জানান তিনি। মল্লিকপুরের খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ূম তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন- তিনটি উপজেলা থেকে আতপ চাল সংগ্রহ করে সেগুলো তারা ডিলারদের কাছে দিয়েছেন। আর এই হিসাবগুলো সপ্তাহ শেষের পরিসংখ্যানের হিসাবে আসেনি। কিন্তু তিনি তিনটি উপজেলা থেকে সংগ্রহ না আতপ চালের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারেনি। দায়সারাভাবে যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন সেখানেও ৭০-৭৫ টন আতপ চালের ঘাটতির বিষয়টি জানা যায়। ঘাটতি চাল সম্পর্কে তিনি জবাব দিতে পারেনি। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মাইনুল ইসলাম জানিয়েছেন- অনেক সময় গুদামে সংকট থাকলে অন্য উপজেলা বা খাদ্য গুদাম থেকে সংগ্রহ করা হয়। বিষয়টি পুরোপুরি তিনি জানেন না। তবে- বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। যদি কোনো ঘাফলা থাকে তাহলে এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি। এদিকে- প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত খাদ্যবান্ধব এই কর্মসূচির চালেও নয়ছয় করার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ভুক্তভোগীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গতকাল বিভিন্ন ডিলার থেকে চাল সংগ্রহকালে তারা জানিয়েছেন- প্রধানমন্ত্রী গরিবদের চিন্তা মাথায় রেখে এই কর্মসূচি শুরু করেছেন। সিদ্ধ চাল পেলে তাদের উপকার হতো বেশি। যে আতপ চাল দেয়া হচ্ছে সেটিও নিম্নমানের। সংসারে টানাটানি থাকায় বাধ্য হয়ে তারা এগুলো নিচ্ছেন বলে জানান।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: