মেট্রোরেলের লোগো ডিজাইনার নিশানের গল্প

বিজয়ে-উন্নয়নে-বিকাশে ছুঁয়ে যাওয়া নিশান তার নাম। পুরোনাম আলী আহসান নিশান। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকারু কলায়। পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে মেধার স্বীকৃতি স্বর্ণপদক। সেই নিশান উড়িয়েছেন, মেট্রোরেলের লোগো আঁকায় বিজয়ের নিশান। নিশানের সেই বিজয়ের গল্প এখানে মেলে ধরা হলো—

মেট্রোরেলের লোগো ডিজাইনার নিশানের গল্প

প্রথম নিউজ, ঢাকা: বছর না পেরুতেই সাধারণ জনগণ সুযোগ পাবে মেট্রোরেলে ওঠার। তাই মেট্রোরেলের মহাযজ্ঞ শুরুর আগেই লোগো নিয়ে ব্যাপক আয়োজন ছিল। নানাজন এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। সবাইকে টপকে চারুশিল্পী আলী আহসান নিশানের লাল-সবুজের করা লোগোটি নির্বাচিত হয়। লোগোটি চূড়ান্ত করেন  স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

দুর্দান্ত এক লোগো, একটা লাল সূর্য উঠছে। নিচে বাংলার চিরচেনা সবুজের মাখামাখি। দুয়ে মিলে বাংলাদেশ। মেট্রোর ‘এম’ অক্ষরটাও এমনভাবে বসানো, মনে হয় যেন প্ল্যাটফর্ম। রেলটির দিকে কিছুক্ষণ তাকালেই মনে হবে, ওটা স্থির নয়, ছুটে চলেছে। উন্নয়ন-অগ্রগতিতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াই যেন ইঙ্গিত করছে ওটা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মেধাবী ছাত্র আলী আহসান নিশান জানালেন লোগো তৈরির গল্প। বলতে দ্বিধা নেই বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির ইতিহাসের  সঙ্গে নওগাঁর কৃতি সন্তান আলী আহসান নিশানের নাম যুগ যুগ অমলিন থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন আলী আহসান নিশান জানিয়েছেন, ‘শুধু লোগো নয় বাংলাদেশে ভবিষ্যতে যতগুলো মেট্রোরেলের সাইনেও তার করা ডিজাইন ব্যবহার হবে।’ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার শুরুটা কীভাবে জানতে চাইলে আলী আহসান নিশান বলেন, ‘তখন মাত্র পাস করে বেরিয়েছি। ভালো রেজাল্টের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে স্বর্ণপদকও নিয়েছি। তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ করে উঠতে পারিনি। বিভাগে শিক্ষকের এক আমাকে এই লোগো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বললেন। ওটা ছিল স্বপ্ন পূরণের আহ্বানের মতো। আমি কাজটি করে জমা দিই। অনেকেই জমা দিয়েছিল। অবশেষে আমাদের চারুকলা থেকে তিনটি লোগো পাঠানো হয়। আমার দুটো, আরেকজনের একটা।’ আলী আহসান নিশান আরো বললেন, ‘এরপর জাতীয়ভাবে জমা হওয়া লোগোগুলো থেকেও শর্টলিস্ট করা হয়। সেখান থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার লোগোটি চূড়ান্ত করেন।’ লোগো চূড়ান্ত হওয়ার খবর শুনে কেমন লেগেছে? অনুভূতি প্রকাশে আলী আহসান নিশানের ঝটপট জবাব, ‘এটা কিছুতেই বলে বোঝানো সম্ভব নয়! আনন্দ, উৎসাহ সব মিলিয়ে অন্যরকম!’

এক প্রশ্নে জবাবে আলী আহসান নিশান বলেছেন, ‘মেট্রোরেলের স্টেশনে যে সাইনগুলো থাকবে, সেগুলোও আমার করা। দেশের মানুষ যে জিনিসগুলো ব্যবহার করবেন সেখানে আপনার সম্পৃক্ততা আছে যখনই জানবেন, সেটার অন্যরকম একটা অনুভূতি হবেই। দেশের সব স্তরের মানুষ যেন চিহ্নগুলো দেখেই বুঝতে পারেন কোনদিকে যেতে হবে, টয়লেট কোনদিকে, টিকিট কোথায় পাবেন— এসব ভাবতে হয়েছে।’

 
আলী আহসান নিশান আরো জানিয়েছেন, ‘মেট্রোরেল দেখতে কেমন সেটাও জানা ছিল না। তাই প্রথম যে রেলটা ব্যবহার করেছিলাম সেটি দেখতে বুলেট ট্রেনের মতো ছিল। পরে যখন মেট্রোরেলের ইঞ্জিন দেখলাম তখন কিছুটা পরিবর্তন করে দেওয়া হলো। পুরো কাজ শেষ করতে ছয় মাসের মতো লেগেছে। যখন কাজটি হলো আমি ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম। অনেক প্রতিষ্ঠানের লোগো করেছি, কিন্তু এতটা ভালো লাগা কাজ করেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হওয়ার আনন্দ অবশ্যই অন্যরকম।’

আলী আহসান নিশান জানান, ‘আমি রাস্তায় রাস্তায় গিয়ে নানা জনকে জিজ্ঞেস করেছি। চিহ্নগুলো দেখিয়ে জানতে চেয়েছি, এইটা কী? যখন দেখেছি চিহ্ন দেখেই বলে দিতে পেরেছে এখানে টিকিট দেবে, তখন সেটাই চূড়ান্ত করেছি।’ আলী আহসান নিশান লোগোর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, ‘বাংলাদেশের যে উন্নয়নের গতি, সেটা লোগোর দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যাবে। সাধারণত লোগো স্থির প্রকৃতির হয়। এর রঙের ব্যবহারেও এক ধরনের ভারসাম্য থাকে। যেন চোখটা আটকে থাকে। কিন্তু এই লোগোতে সেটা ইচ্ছে করেই রাখা হয়নি। এতে এক ধরনের গতি আছে।’

লোগো একবারেই চূড়ান্ত হয়েছিল, নাকি কয়েকবার কাজ করতে হয়েছে? নিশানের উত্তর—“প্রথম ধাপে চূড়ান্ত হওয়ার পর কয়েকদফা কাজ হয়েছে। ‘এম’ অক্ষরটি লিখে যে প্ল্যাটফর্ম বোঝানো হয়েছে, প্রথমে তা ছিল না। বিশ্বের ৩৫টি দেশে মেট্রোরেলের লোগোতে ‘এম’ রয়েছে। ওটাকে যুক্ত করার সময় একটু ইনোভেটিভ ওয়েতে করেছি।”

নিশানের লক্ষ্য আরো অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ায়। ইতোমধ্যে নিশান অসংখ্য স্মৃতিফলকের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। চারু-কারুর নান্দনিকতায় নিজেকে মেলে ধরেছেন বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী কাজে। চাকরি নয়, নিজেই কিছু করার অদম্য স্পৃহা নিয়ে ছুটছেন এই তরুণ মেধাবী উদ্যোক্তা। এ ব্যাপারে আলী আহসান নিশান বলেছেন, ‘যুগযুগ বেঁচে থাকার মতো কিছু করতে চাই। এখন তেমন কিছু করতে পারিনি। পাশাপাশি যাপিত জীবনে নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান নিয়ে মানুষের জন্য কিছু করতে চাই।’ নিশান নিজেই গড়ে তুলেছেন একটি চারুকারু স্কুল। যেখানে শিশুরা এসে ছবি আঁকা শিখে; আঁকে নিজেরাও। সেই ছবি আঁকা নিশানকে প্রতিদিন অনুপ্রাণিত করে। নিশান অক্সিজেন পান নিজ কর্মস্পৃহায়।