পিলখানা হত্যা মামলা: চূড়ান্ত শুনানির আগে সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার নির্দেশ
১৪ বছরেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলা।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: ১৪ বছরেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলা। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের রায়ের পর মামলাটি এখন আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়, যা পরে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। মামলা হাইকোর্টে নিষ্পত্তির পর এবার আপিল বিভাগে চূড়ান্ত আপিল শুনানির অপেক্ষায়। হত্যা মামলায় আপিল ও লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) শুনানির অপেক্ষায়। তবে বিস্ফোরক মামলাটি এখনো বিচারিক আদালতের গণ্ডি পেরোয়নি।
আসামিপক্ষের এক আইনজীবী বলেন, শুনানির জন্য আমরা প্রস্তুত। যদিও আসামিদের অনেক আইনজীবী এখনও মামলার সারসংক্ষেপ আপিল বিভাগে জমা দেননি। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, তারা চলতি বছরই আপিল শুনানি শুরু ও শেষ করতে চায়। এজন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে কবে নাগাদ আপিল বিভাগের শুনানি আনুষ্ঠনিকভাবে শুরু হবে সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি। মামলায় হাইকোর্টে খালাস পেয়েছে এমন ২০ জনের সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আর নিম্ন আদালতে খালাস হয়েছিল কিন্তু হাইকোর্টে এসে সাজা বেড়েছে এমন আসামিদের মধ্যে আপিল করেছেন ৩৩ জন। চলতি (মে) মাসের শুরুতে এদের সবাইকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে বলা হয়েছে। এই সারসংক্ষেপ জমা না দেওয়ার কারণে শুনানি শুরু করা যাচ্ছে না। এরপরও যারা সারসংক্ষেপ জমা দেবেন না তাদের আবেদন খারিজ হয়ে সাজা বহাল হবে বলেও জানান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। বিষয়টি আসামিপক্ষের আইনজীবী জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন।
এর আগে ২০২০ সালে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ২০৪ জন আসামি পৃথক আপিল ও লিভ টু আপিল করেন। খালাস পাওয়া ও সাজা কমা ৮৩ আসামির ক্ষেত্রে ২০টি লিভ টু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এখন এসব আপিল ও লিভ টু আপিল শুনানির অপেক্ষায়। আসামির সংখ্যার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা এটি।
জানা গেছে, খালাস চেয়ে ২০৪ জন আসামির পক্ষে আপিল আবেদন করলেও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আসামিদের পক্ষে সব আইনজীবী তাদের সারসংক্ষেপ এখনো জমা দেননি। আর ৮৩ জনের সাজা বৃদ্ধি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে লিভ টু আপিল করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ তাদের সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছে। এখন আপিল শুনানির উদ্যোগ নিলে বিচারের মধ্য দিয়ে বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। যদিও এরপর রিভিউ আবেদন করা যাবে। রিভিউ নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আগামী মাসে লিভ টু আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। অবশ্য আসামিপক্ষের মতে, আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়া ও প্রস্তুত হওয়া সাপেক্ষে চলতি বছর আপিল ও লিভ টু আপিলের ওপর শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা কম। মামলার পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পর্কে একাধিক আইনজীবী বলেন, আপিল দায়েরের পর সাধারণত সংক্ষুব্ধ পক্ষ অন্য পক্ষকে আপিলের সংক্ষিপ্তসার সরবরাহ করে। লিভ টু আপিলের ক্ষেত্রে আদালতে শুনানি হয়। সংক্ষুব্ধ পক্ষের লিভ টু আপিল মঞ্জুর হলে নিয়মিত আপিল হিসেবে তা রূপান্তরিত হবে। এসব প্রক্রিয়া শেষে আপিলের ওপর শুনানি হয়।
হত্যা মামলা: ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ করেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছু সদস্য। তারা পিলখানায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালান। তাদের নিষ্ঠুর আচরণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকের পরিবারের সদস্য। ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি দুদিনের ওই বিদ্রোহ শেষে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। ‘পিলখানা হত্যা’মামলা হিসেবে পরিচিত ওই মামলায় আসামি ছিলেন ৮৫০ জন। বিচারিক আদালতের রায়ে ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। আর খালাস পান ২৭৮ জন।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে অনুমোদনের জন্য আসে। ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে বিশেষ ও বৃহত্তর বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন।
চূড়ান্ত শুনানির আগে সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার নির্দেশ
হাইকোর্টের রায়ে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ২২৮ জনকে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ অন্যরা খালাস পান। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর ২০২০ এবং ২০২১ সালে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ পৃথক আপিল ও লিভ টু আপিল করে। অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এ এম) আমিন উদ্দিন বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ গত ডিসেম্বরে লিভ টু আপিল দায়ের করেছে। আসামিপক্ষ সরাসরি কয়েকটি আপিল ও লিভ টু আপিল দায়ের করেছে। এখন লিভ টু আপিল শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল ফাইল করা হয়েছে, সেহেতু এটা অধিকাংশ আপিল-ই রেডি (প্রস্তুত)। শুধু কিছু আপিল রেডি না হওয়ার কারণে মামলাটি শুনানি করা যাচ্ছিল না।
চূড়ান্ত শুনানির আগে সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার নির্দেশ
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা জানান, যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন শুনানির আগে নিয়ম অনুযায়ী আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে হয়, ওইগুলো আসামিপক্ষ জমা দেয়নি। আমরা জানতে পেরেছি ৩৩টির মধ্যে ৩০টি মামলায় সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছে। বাকি তিনটি এখনো জমা দেয়নি। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ওনাদের ছয় সপ্তাহের সময় দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে যদি সারসংক্ষেপ জমা না দেন তারপরও মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হবে।
হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা সাবেক ডিএডি সৈয়দ তৌহিদুল আলমসহ দণ্ডপ্রাপ্ত সাড়ে তিনশ’র বেশি আসামির আইনজীবী ছিলেন মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়া ও আপিল প্রস্তুত হওয়া সাপেক্ষে চলতি বছর আপিল ও লিভ টু আপিলের ওপর শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা মামলায় সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছি। আবার অনেকেই সারসংক্ষেপ জমা দেননি। তাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সবাইকে মামলার সারসংক্ষেপ জমা দিতে বলেছেন। তিনি জানান, মামলায় আপিল বিভাগের নির্দেশের পরও যেসব আসামির আইনজীবীরা তাদের পক্ষে সারসংক্ষেপ জমা দেবেন না তাদের আবেদন খারিজ হয়ে সাজা বহাল হয়ে যাবে বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
বিস্ফোরক আইনে করা মামলার বিচার এক যুগেও শেষ হয়নি। এ মামলায় ১ হাজার ৩৪৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। বিচারকাজ চলছে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদরাসাসংলগ্ন মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে। এ মামলায় আসামি ৮৩৪ জন। তাদের মধ্যে ৩৩ আসামি এরই মধ্যে মারা গেছেন এবং ২০ জন আসামি পলাতক। ৭৮১ আসামি কারাগারে। আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, মামলাটির নিষ্পত্তি কবে হবে, তা অনিশ্চিত। হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে ২৭৮ জন খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলায় আসামি থাকায় তারা বের হতে পারেননি।
এ মামলার পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এর আগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বিচারকাজ বেশ কিছুদিন স্থগিত ছিল। বছরের শেষভাগে ২০২১ সালে আবার কার্যক্রম শুরু হয়, যা চলমান। এ বছরই মামলাটি নিষ্পত্তি হতে পারে বলে আশা করেন তিনি।
এছাড়া বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিচার হয় অধিনায়কদের সামারি ট্রায়ালে (সংক্ষিপ্ত বিচার)। তাতে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। তাদের মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। অন্যরা প্রশাসনিক দণ্ড শেষে আবার চাকরিতে যোগ দেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে সারাদেশে বিশেষ আদালত গঠন করে বিচার করা হয়। বিশেষ আদালতে ৫৭টি মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জন জওয়ানের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। বিচার চলার সময় মারা গেছেন পাঁচজন।
অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, এ মামলা দুটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা। আপিল নিষ্পত্তির জন্য আপিল বিভাগের বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা যেতে পারে। প্রধান বিচারপতি এই উদ্যোগ নিতে পারেন। এছাড়া কতদিনে এই আপিল নিষ্পত্তি হবে সেটি বলা মুশকিল। বিচারিক আদালতে বিস্ফোরক মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে পারে আইন মন্ত্রণালয়। কারণ আপিল নিষ্পত্তির পর এই মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে রিভিউ আবেদনের আরেকটি ধাপ বাকি থাকবে। বিচারিক আদালতে বিস্ফোরক মামলার রায়ের পর সেটি হাইকোর্টে আসবে। সেখানে নিষ্পত্তির পর আপিল হবে, আপিল নিষ্পত্তির পর রিভিউ আবেদন হবে। অর্থাৎ মামলা দুটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা সময়সাপেক্ষ বিষয়।