দিল্লি-ওয়াশিংটন সম্পর্কে টানাপড়েনের আভাস!
বিশাল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং চীনের আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার লাগাম টানতে ভারতকে প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। ধারণা করা হচ্ছিল, এ কারণেই ভারতের এস-৪০০ কেনা থেকে শুরু করে বর্তমানে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানির বিষয়গুলোকে মেনে নিচ্ছিল ওয়াশিংটন। তবে এবার নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটন সুসম্পর্কে ছন্দপতনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
প্রথম নিউজ ডেস্ক: সামপ্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ক একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। নয়াদিল্লিকে বন্ধুর তালিকায় স্থান দিয়েছে ওয়াশিংটন। জো বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও দাবি করেছেন যে, একবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভারতের প্রতি তার নমনীয়তার বিষয়ে রাখডাক রাখেননি। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যখন ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তখন ভারত উল্টো রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছে। ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য নিন্দা জানানো দূরে থাক, ভারত উল্টো এই দুঃসময়ে রাশিয়ার অর্থনীতি শক্তিশালী রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। মার্কিন বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করেই রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল, প্রতিরক্ষাসামগ্রী ও সার আমদানি করছে ভারত। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও ভারতের বিরুদ্ধে জোরদার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কখনো।
বিশাল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং চীনের আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার লাগাম টানতে ভারতকে প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। ধারণা করা হচ্ছিল, এ কারণেই ভারতের এস-৪০০ কেনা থেকে শুরু করে বর্তমানে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানির বিষয়গুলোকে মেনে নিচ্ছিল ওয়াশিংটন। তবে এবার নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটন সুসম্পর্কে ছন্দপতনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সমপ্রতি ‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন ধনকুবের জর্জ সোরোস ভারতের গণতন্ত্রকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ভারত ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তিনি যে বয়ান দিয়েছেন তা রীতিমতো তুলকালাম শুরু হয়েছে। মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সের মতো প্ল্যাটফরমকে তিনি বেছে নেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করার জন্য।
৯২ বছরের সোরোস বলেন, ভারতে যে আদানি ইস্যু চলছে তাতে দেশটিতে একটি গণতান্ত্রিক পরিবর্তন হবে। ভারতের বিষয়টি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি গণতান্ত্রিক নন। মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সৃষ্টি করেই তিনি দ্রুত বড় নেতা হয়েছেন। তিনি বলেন, ভারত কোয়াড-এর মেম্বার। যার মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানও তাদের সঙ্গে রয়েছে। কিন্তু ভারত তা সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে বড় ডিসকাউন্টে তেল কিনছে এবং মুনাফা লাভ করছে। আদানি ইস্যুতে তিনি বলেন, মোদি এবং আদানি ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাদের ভাগ্য একে অপরের সঙ্গে জড়িত। আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মোদি এখনো নিশ্চুপ। তবে তাকে অবশ্যই বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং পার্লামেন্টে জবাব দিতে হবে। আদানির এই আর্থিক ক্ষতির কারণে ভারতের গণতন্ত্রের ‘পুনর্জাগরণ’ হবে বলেও মন্তব্য করেন সোরোস।
জর্জ সোরোসের এই বক্তব্য যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের বক্তব্য নয়। তবে এই বক্তব্যের যে পাল্টা প্রতিক্রিয়া ভারত দেখাচ্ছে সেটিকে উপেক্ষা করা যায় না। এনডিটিভি’র রিপোর্টে জানানো হয়েছে, জর্জ সোরোসের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তাকে রীতিমতো তুলোধুনো করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এক আলোচনা সভায় সোরোসকে ‘বুড়ো, ধনী, জেদি ও বিপজ্জনক’ বলে বর্ণনা করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বলেন, এ ধরনের মানুষ ভাবেন, তিনি যা মনে করেন, সেটাই ঠিক। সারা বিশ্ব সেই ভাবনাতেই চলবে। তিনি আরও বলেন, নিউ ইয়র্কে বসে থেকে এ ধরনের মানুষ ভাবেন, তাদের ইচ্ছামতো পৃথিবী চলবে। সে জন্য এসব মানুষ প্রচুর অর্থ খরচ করেন। তারা মনে করেন, যদি তাদের পছন্দমতো ব্যক্তিরা জেতেন, তা হলে নির্বাচন ভালো হয়েছে। আর তা না হলে সংশ্লিষ্ট দেশের গণতন্ত্র খারাপ। মজার বিষয় হচ্ছে, তারা বোঝাতে চান, উদারপন্থি সমাজের স্বার্থে এসব করা হচ্ছে। কিন্তু এটা স্রেফ ভণ্ডামি। জয়শঙ্কর বলেন, এ ধরনের কথাবার্তা আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাখে। কারণ আমরা জানি, ঔপনিবেশিকতা কী। আমরা সেই অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে গিয়েছি। বাইরের শক্তি নাক গলালে কী বিপদ হয়, তা আমাদের জানা।
নরেন্দ্র মোদিকে অগণতান্ত্রিক দাবি করাকে ‘হাস্যকর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন জয়শঙ্কর। তিনি বলেন, সোরোস মনে করেন ভারত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিন্তু এর প্রধানমন্ত্রী গণতান্ত্রিক নন। এর আগে তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, আমরা মিলিয়ন মিলিয়ন মুসলিমের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে চাইছি। অবশ্যই এসব ঘটনা কখনো ঘটেনি। তার এসব কথা হাস্যকর। তার এসব কথা আমাদের ক্ষতি করছে। কারণ কেউ না কেউ তার কথা বিশ্বাস করছে। জয়শঙ্কর বলেন, আমাদের এখন অবশ্যই গণতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কার দৃষ্টিভঙ্গি আসলে গণতন্ত্রকে প্রতিনিধিত্ব করছে তা জানা প্রয়োজন। কারণ বিশ্ব এখন ইউরো-আটলান্টিক ধারণা থেকে ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। জয়শঙ্কর আরও বলেন, যদি একজন বুড়ো, ধনী এবং একগুঁয়ে ব্যক্তির কাছে থেমে যাই, তাহলে আমাকে এ পথ থেকে সরে যেতে হবে।
ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, জর্জ সোরোসের বক্তব্যের সমালোচনা করা থেকে বাদ যায়নি ভারতের শাসক দল বিজেপিও। বিজেপি নেত্রী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি শুক্রবার বলেন, আজকে একজন ভারতীয় হিসেবে আমি সকল মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই যারা নিজেদের ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য আমাদের গণতান্ত্রিক স্বার্থকে দুর্বল করতে চায়। জর্জ সোরোস শুধু প্রধানমন্ত্রী মোদিকেই আক্রমণ করেননি তিনি ভারতের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকেও টার্গেট করেছেন। তিনি এমন সময় এই মন্তব্য করলেন যখন ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠছে।
ইরানি আরও বলেন, জর্জ সোরোস এমন একটি সরকার চায় যারা তার জঘন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। শুধুমাত্র নরেন্দ্র মোদির মতো নেতাদের টার্গেট করার জন্য তিনি বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন। তার বক্তব্য থেকেই এটি স্পষ্ট হয়ে যায়। সোরোসের মন্তব্যকে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংসের চেষ্টা বলে বর্ণনা করে ইরানি বলেন, আমি সকল ভারতীয়কে এর যথাযথ জবাব দেয়ার আহ্বান জানাই।
সোরোসের ‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন’ বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং মুক্ত সমাজ রক্ষার জন্য তহবিল সরবরাহ করে। এর পেছনে তিনি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন। তবে নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে তার এমন নেতিবাচক মন্তব্যের পর ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে তাকে রীতিমতো তুলোধোনা করা হচ্ছে। যদিও সোরোস নিজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন না, কিন্তু তারপরেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে চলেছে ভারত। জয়শঙ্কর কিংবা স্মৃতি ইরানি তাদের জবাবে শুধু সোরোসকে নয়, গোটা যুক্তরাষ্ট্রকেই টার্গেট করেছেন। একদিকে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অপরদিকে, স্মৃতি ইরানি ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদেশি ‘ষড়যন্ত্র’ রুখে দিতে বলছেন।
ভারতের ‘কূটনৈতিক স্বাতন্ত্র্য’ বজায় রাখার দীর্ঘদিনের নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আগে থেকেই কিছুটা সন্দেহ ছিল। যদিও চীনকে ঠেকাতে ভারতের বিকল্প নেই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। মূলত পররাষ্ট্রনীতির চীনকেন্দ্রিক অগ্রাধিকারগুলোর কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক এত গভীরতায় পৌঁছায়। তবে সর্বশেষ এই উত্তেজনা এখন এক নতুন টানাপড়েনের আভাস দিচ্ছে।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: