তল্লা ট্র্যাজেডির দুই বছর, বিচার কাজ দ্রুত চায় মসজিদ কমিটি

মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৩৪ জন নিহতের ঘটনায় ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুর গফুরসহ ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

তল্লা ট্র্যাজেডির দুই বছর, বিচার কাজ দ্রুত চায় মসজিদ কমিটি
মসজিদ বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ৩৪ মুসল্লি

প্রথম নিউজ, নারায়ণগঞ্জ: আজ ৪ সেপ্টেম্বর, দুই বছর আগে ঠিক এ দিন রাতে নারায়ণগঞ্জে ঘটেছিল ভয়াবহ বিস্ফোরণ। মসজিদে নামাজ পড়তে এসে আগুনে ঝলসে গিয়েছিলেন অনেক মুসল্লি। নিজেকে বাঁচাতে অনেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন নর্দমার পানিতে। এরপরও শেষ রক্ষা হয়নি। হাসপাতালের বেডে কাতরাতে কাতরাতে শিশুসহ একে একে ৩৪ জন মানুষ প্রাণ হারান। এখনো সেই ঘটনার কথা মনে হলে আঁতকে ওঠেন এলাকাবাসী।

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত: প্রতিদিনের মতোই ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার তল্লায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজ পড়তে আসেন মুসুল্লিরা। ইমামের পেছনে ৪ রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করে কেউ কেউ বেরিয়ে যান। তবে বেশিরভাগ মুসুল্লিই ভেতরে সুন্নত নামাজ আদায় করছেন। এর মধ্যে তিতাসের জমে থাকা গ্যাস থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের ভেতরে থাকা মানুষগুলোর শরীর ঝলসে যায়। কারও কারও শরীরে কোনো কাপড়ই ছিল না। এরপরেই এলাকাজুড়ে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। ঝলসে যাওয়া মানুষগুলোকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে কয়েকজন সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারলেও ৩৪ জনের প্রদীপ নিভে যায়।

যে ৩৪ জন নিহত হয়েছিল: নিহতদের মধ্যে রয়েছেন পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক নেসারি (৪৮), মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন (৪৫) ও তার ছেলে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের বাসিন্দা জুনায়েদ হোসেন (১৬), মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান (৫০), ইমরান (৩০), আবুল বাশার (৫১), মোহাম্মদ আলী মাস্টার (৫৫), জেলা প্রশাসনের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী শামীম হাসান (৪৫), স্থানীয় ফটো সাংবাদিক মোহাম্মদ নাদিম (৪৫), তল্লার বাসিন্দা নূর উদ্দিনের বড় ছেলে নারায়ণগঞ্জ কলেজের ছাত্র সাব্বির (২১) ও মেজ ছেলে তোলারাম ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র জোবায়ের (১৮), জুলহাস উদ্দিন (৩০), মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হাটবুকদিয়া গ্রামের কুদ্দুস ব্যাপারী (৭২), চাঁদপুর সদর উপজেলার করিম মিজির ছেলে মোস্তফা কামাল (৩৪), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পোশাক শ্রমিক জুলহাস ফরাজীর ছেলে জুবায়ের ফরাজী (৭), পটুয়াখালীর গলাচিপার আবদুল খালেক হাওলাদারের ছেলে পোশাক শ্রমিক মো. রাশেদ (৩০), পশ্চিম তল্লার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির (৭২), পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার কাউখালী গ্রামের জামাল আবেদিন (৪০), পোশাক শ্রমিক ইব্রাহিম বিশ্বাস (৪৩), নারায়ণগঞ্জ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী রিফাত (১৮), চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাইন উদ্দিন (১২), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মো. জয়নাল (৩৮), লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তালুকপলাশী গ্রামের মেহের আলীর ছেলে পোশাক শ্রমিক মো. নয়ন (২৭), ফতুল্লার ওয়ার্কশপের শ্রমিক কাঞ্চন হাওলাদার (৫০), শ্রমিক মো. রাসেল (৩৪), বাহার উদ্দিন (৫৫), নিজাম ওরফে মিজান (৪০), আবদুস সাত্তার (৪০), শেখ ফরিদ (২১), নজরুল ইসলাম (৫০), ফতুল্লার নিউখানপুর ব্যাংক কলোনির আনোয়ার হোসেনের ছেলে রিফাত (১৮)।

তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তরা: মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৩৪ জন নিহতের ঘটনায় ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুর গফুরসহ ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

অন্য অভিযুক্তরা হলেন- মো. সামসুদ্দিন সরদার (৬০), মো. শামসু সরদার (৫৭), মো. শওকত আলী (৫০), মো. অসিম উদ্দিন (৫০), মো. জাহাঙ্গীর আলম (৪০), মো. শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল (৪৫), মো. নাঈম সরদার (২৭), মো. তানভীর আহমেদ (৪৫), মো. আল আমিন (৩৫), মো. আলমগীর সিকদার (৩৫), মাওলানা মো. আল আমিন (৪৫), মো. সিরাজ হাওলাদার (৫৫), মো. নেওয়াজ মিয়া (৫৫), মো. নাজির হোসেন (৫৬), মো. আবুল কাশেম (৪৫), আব্দুল মালেক (৫৫), মো. মনিরুল (৫৫), মো. স্বপন মিয়া (৩৮), মো. আসলাম আলী (৪২), আলী তাজম মিল্কী (৫৫), মো. কাইয়ুম (৩৮), মো. মামুন মিয়া (৩৮), মো. দেলোয়ার হোসেন, মো. বশির আহমেদ হৃদয় (২৮), মো. রিমেল (৩২), মো. আরিফুর রহমান (৩০), মো. মোবারক হোসেন (৪০) ও রায়হানুল ইসলাম (৩৬)।

এদিকে তিতাস গ্যাসের অভিযুক্ত আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। পরে তাদেরও অভিযুক্ত করা হয়। তারা হলেন- তিতাসের ফতুল্লা অঞ্চলের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম, উপ ব্যবস্থাপক মাহামুদুর রহমান রাব্বী, সহকারী প্রকৌশলী এসএম হাসান শাহরিয়ার, সহকারী প্রকৌশলী মানিক মিয়া, সিনিয়র সুপারভাইজার মো. মুনিবুর রহমান চৌধুরী, সিনিয়র উন্নয়নকারী মো. আইউব আলী, হেলপার মো. হানিফ মিয়া ও কর্মচারী মো. ইসমাইল প্রধান।

অভিযোগপত্রে যা উল্লেখ করা হয়: অভিযোগপত্রে মসজিদ পরিচালনায় কমিটির অবহেলা-অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা, কারিগরি দিক বিবেচনা না করে অবৈধ বিদ্যুৎসংযোগ ঝুঁকিপূর্ণভাবে লাগানো, গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েও মুসল্লিদের জীবনের নিরাপত্তায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নেওয়া, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মিটার রিডার কালেক্টর ও ইলেক্ট্রিশিয়ানদের মসজিদে অবৈধ বিদ্যুসংযোগ দেওয়াসহ তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা, গ্যাসলাইন সঠিকভাবে তদারকি না করা, পাইপের লিকেজ মেরামত না করা, গ্যাসলাইন ঝুঁকিপূর্ণভাবে স্থাপন এবং স্থানান্তর না করার কারণে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৩৪ মুসল্লির মৃত্যু হয়।

এদিকে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও দায়ী করা হয় তিতাস, ডিপিডিসি ও মসজিদ কমিটিকে। ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনের হাতে ৪০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি। তদন্তে গ্যাস লাইনে লিকেজ, বিদ্যুতের সর্ট সার্কিট, মসজিদ কমিটির অবহেলা ও রাজউকের অব্যবস্থাপনাকে বিস্ফোরণের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

প্রতিবেদন দাখিলের পর তদন্ত কমিটির প্রধান খাদিজা তাহেরা ববি জানিয়েছিলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে তিতাস গ্যাস পাইপের লিকেজ, বিদ্যুৎ বিভাগের ত্রুটি, মসজিদ কমিটির গাফিলতি, ভবন নির্মাণে রাজউকের অব্যবস্থাপনা এবং মসজিদের সামনের রাস্তা নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের অবহেলার বিষয়টি এসেছে। এছাড়া এসব অনিয়ম রোধে তদন্ত কমিটি জেলা প্রশাসকের কাছে ১৮টি সুপারিশ পেশ করেছে। এর মধ্যে মসজিদ নির্মাণের আগে আর্কিটেক্ট দিয়ে নকশা ডিজাইন করা, মসজিদ বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন সংযোগের ব্যাপারে ম্যাপ আকারে বিভিন্ন দিক নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

শর্তসাপেক্ষে সেই মসজিদে চলছে নামাজ আদায়: ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে কয়েক দফা শর্তের ভিত্তিতে মসজিদ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

শর্তগুলো হলো- মসজিদে একাধিক দরজা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে এবং আপাতত মসজিদটিতে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ (এসি) যন্ত্রের ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে, বিদ্যুতের প্যানেল বোর্ড মসজিদ ভবনের বাইরে অথবা বারান্দায় বসাতে হবে, প্রতি তিনমাস পর পর অনুমোদিত প্রকৌশলী, এবিসি লাইসেন্সপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ান দ্বারা পরীক্ষা করে রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করতে হবে, স্থানীয় বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক মসজিদের বিদ্যুৎ সংক্রান্ত সব কার্যক্রমের সঠিকতা নিশ্চিত করতে হবে।

মসজিদের নিচে বা পাশে গ্যাস লাইন নেই অথবা গ্যাস লাইন সঠিক আছে মর্মে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিশ্চিত করতে হবে, মসজিদের প্রতিটি তলায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামাদি রাখতে হবে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথভাবে মনিটরিং করাসহ এসব শর্তাবলি পালন নিশ্চিত করতে হবে।

আইনি ঝামেলা শেষ করে মসজিদের সংস্কার করতে চান কমিটি: মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুর জাগো নিউজকে বলেন, আমরা চাই এ ঝামেলা যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়। মসজিদ কমিটিতে যারা আছি সবাই সেবা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি কথা চিন্তা করেই এসেছিলাম। এখন হঠাৎ করে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমাদের মসজিদ কমিটির সেক্রেটারিও মারা গেছেন এ ঘটনায়। এখন প্রত্যেক মাসেই কোর্টে গিয়ে আমাদের হাজিরা দিতে হয়। কমিটির অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থাতেও তারা আদালতে হাজিরা দেন। ঝামেলা শেষ হয়ে গেলে আমরা সবাই মুক্তি পাই।

তিনি আরও বলেন, মসজিদেরও সংস্কার কাজ করা যাচ্ছে না। মামলার কার্যক্রম শেষ হয়ে গেলে মসজিদের সংস্কার কাজ করতে পারবো। মসজিদের বর্তমান সেক্রেটারি অসিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, মসজিদ কমিটিসহ এলাকাবাসীর চাওয়া হচ্ছে যেন দ্রুত আইনি ঝামেলা শেষ হয়। এটা তো সামাজিক কাজ। যদি আমাদেরকে দায়ী করা হয় তাহলে কেউ মসজিদ কমিটিতে আসতে চাইবে না। মসজিদও পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। সুতরাং মানবিক দিক বিবেচনা করে যেন দ্রুত বিচার কার্যক্রম শেষ করা হয়।

বিচারাধীন রয়েছে মামলা: মসজিদ কমিটি তথা অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সোলাইমান মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে তিতাস কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত না করেই মামলাটির বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়েছিল। পরে আবার তাদের অন্তর্ভুক্ত করে বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। একই সঙ্গে মামলাটি এখন বিচারাধীন রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান বলেন, মামলাটির বিচারের জন্য তদন্ত শেষে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়েছিল। তবে সেখানে আটজন আসামি বাদ পড়েছিল। পরে উচ্চ আদালত বলেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য। নিম্ন আদালত তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছিল। মামলাটি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পূর্ণভাবেই বিচারাধীন রয়েছে। যাদের আইনের আওতায় আনার জন্য বলা হয়েছিল তাদের আনা হয়েছে। ২৫ সেপ্টেম্বর শুনানি হবে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom