তাঁত বোর্ডে দুর্নীতি: কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা
তাঁত বোর্ডের দুটি সার্ভিস সেন্টারের জন্য ৫৮ কোটি ২৭ লাখ টাকার মেশিন কেনাকাটায় অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির তদন্তেও। ওই কমিটির তদন্তের পর তাঁত বোর্ডের ৭ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে।
প্রথম নিউজ, সিরাজগঞ্জ: তাঁত বোর্ডের দুটি সার্ভিস সেন্টারের জন্য ৫৮ কোটি ২৭ লাখ টাকার মেশিন কেনাকাটায় অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির তদন্তেও। ওই কমিটির তদন্তের পর তাঁত বোর্ডের ৭ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং তাঁত বোর্ডের যৌথভাবে গঠিত সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব রেজাউল করিম। কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন তাঁত বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন। এছাড়া সদস্য ছিলেন—বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বস্ত্র) মাহবুবুর রহমান ভূঁঞা, সিনিয়র সহকারী সচিব (বস্ত্র) আছিয়া খাতুন, বস্ত্র অধিদফতরের প্রতিনিধি ও বিজেএমসির একজন প্রতিনিধি।
এই কমিটির তদন্তে যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশন (বিবরণ) পরিবর্তন করে ওয়ার্ক অর্ডার, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়া, প্রকল্প এলাকায় কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করা, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সরকারি কোষাগারে অর্থ ফেরত না দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলা ট্রিবিউনের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ ও দলিলাদির কপি আছে।
এসব অনিয়মের সঙ্গে তাঁত বোর্ডের বর্তমান ও সাবেক ছয়-সাত জন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পায় তদন্ত কমিটি। এর অন্যতম হলো—প্রকল্পের প্রথম পরিচালক ও তাঁত বোর্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পরিচালক মো. আইয়ূব আলী। তিনি দুই দফায় এই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের তালিকায় আরও যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন—২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত থাকা প্রকল্প পরিচালক ও তাঁত বোর্ডের সাবেক সদস্য (অর্থ) মামুনুর রহমান খলিলী, উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) মঞ্জুরুল ইসলাম, বর্তমান প্রকল্প পরিচালক ও তাঁত বোর্ডের উপ-প্রধান (পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন) মোহাম্মদ ইছা মিয়া। আউয়ুব আলী, মঞ্জুরুল ইসলাম ও ইছা মিয়া তাঁত বোর্ডের বর্তমান কর্মকর্তা।
প্রকল্পটিতে ৯ দফায় সাত জন পরিচালক ছিলেন। ওপরের তিন জন ছাড়া বাকি চার জন পরিচালক ছিলেন—যুগ্ম সচিব হুমায়ুন কবির, যুগ্ম সচিব রেজাউল করিম, যুগ্ম সচিব ফজলুর রহমান ভুঞা ও অতিরিক্ত সচিব জাকির হোসেন। তাদেরও দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে। বিভাগীয় মামলার বিষয়ে তাঁত বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন) সুকুমার চন্দ্র সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এগুলো খুবই গোপনীয় বিষয়। সবকিছু আমি জানি না। চেয়ারম্যানের সইয়ে মামলা হয়ে থাকে। আমার সবকিছু জানা নেই।’
২০২১ সালের জুন মাসে মেয়াদ শেষ হলেও এখনও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। সাধারণত প্রকল্পের কাজ কত শতাংশ শেষ হলো, কত শতাংশ বাকি রয়েছে, তার অগ্রগতি প্রতিবেদন দেখে প্রয়োজনে প্রকল্পের সময় বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু এই প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হলেও তা বাড়ানোর জন্য কোনও উদ্যোগ নেননি সংশ্লিষ্টরা। ফলে প্রকল্পের মেয়াদও আর বাড়েনি। এছাড়া প্রকল্প শেষে অবশিষ্ট অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার শর্ত থাকলেও তাঁত বোর্ড এখন পর্যন্ত সরকারকে বাকি অর্থ ফেরত দেয়নি।
জানা গেছে, তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম চলতি বছরের ১১ আগস্ট প্রকল্পের হালনাগাদ তথ্য জানিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুন মাসে সমাপ্ত দেখানো হয়েছে। ইতোমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সব যন্ত্রপাতি প্রকল্প এলাকায় নিয়ে এসেছে। মেশিনের সঠিকতা ও কারিগরি বিনির্দেশ যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনে বুয়েট ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি থেকে একটি নিরপেক্ষ কারিগরি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। যন্ত্রপাতি চুক্তিবহির্ভূত হলে সেগুলো অপসারণ ও পরিবর্তন করে দেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর পর চেয়ারম্যান প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতেও অনুরোধ করেছেন চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের আওতায় দুটি সার্ভিস সেন্টারের জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও স্থাপন প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করার অনুরোধ। এছাড়া তিনি মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডের অপরিশোধিত বিল পরিশোধের অনুমতি চেয়েছেন।
চিঠিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পের আওতায় কার্যাদেশকৃত অধিকাংশ মেশিনারিজ প্রকল্প মেয়াদ শেষে প্রকল্প স্থলে পৌঁছায়। সর্বশেষ গত ১০ এপ্রিল ওয়াশিং ফাস্টনেস টেস্টার মেশিনটি আসে। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর একটি মেশিন এখনও আমদানি করা সম্ভব হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি না করায়, যন্ত্রপাতি যাচাই-বাছাই করে বুঝে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডকে বিলও পরিশোধ করা যাচ্ছে না।’
জানা গেছে, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় কেন্দ্র দুটিতে মেশিনারিজ স্থাপন, প্রশিক্ষণ, ট্রায়েল প্রোডাকশনের কাজ হচ্ছে না। মূলত প্রকল্পের কাজ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মেশিনারিজ আমদানি করায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিলও দিতে পারছে না তাঁত বোর্ড। সরেজমিন দেখা গেছে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর সেন্টারটির বাইরে খোলা জায়গায় এখনও অনেক যন্ত্রপাতি পলিথিন প্যাঁচানো অবস্থায় পড়ে আছে। এ অবস্থায় যন্ত্রপাতিগুলো দুই বছর ধরে পড়ে থেকে ও পানিতে ভিজে নষ্ট হচ্ছে। কুষ্টিয়া সেন্টারের যন্ত্রপাতিও একইভাবে খোলা জায়গায় পড়ে আছে।
তাঁত শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি শেষ হলে লাভবান হতো প্রায় দেড় লাখ তাঁতি। সার্ভিস সেন্টার দুটিতে ৮০ শতাংশ মেশিনপত্র প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বলে দাবি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। তারা জানান, এখনও কিছু মেশিন বাইরে রয়েছে। জায়গার সংকুলন না হওয়ায় এসব মেশিন প্রতিস্থাপন করা যাচ্ছে না। প্রয়োজনের তুলনায় ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে বলেও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে। সেন্টারের জন্য যে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় ছোট।
তাঁত বোর্ড জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়ে সার্ভিস সেন্টারগুলো শেষ হলে অন্তত এক লাখ ৪০ হাজার তাঁতি উপকৃত হতো। সার্ভিস সেন্টারে প্রশিক্ষণ পেলে তাঁতিদের উৎপাদনও বেড়ে যেতো। এখান থেকে মোট ৪৫.০২ লাখ কেজি সুতা রঙকরণ এবং ২৫.২২ কোটি মিটার কাপড়ে সার্ভিস প্রদান সম্ভব হতো। সেন্টার দুটি চালু হলে কাপড় উৎপাদনে ত্রুটির হার হ্রাস পাবে এবং মানসম্পন্ন কাপড় উৎপাদিত হবে বলেও জানিয়েছে তাঁত বোর্ড।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews