Ad0111

এক নাইমই পাচার করেছেন ৫০০ মানুষ

নকল হচ্ছে বিএমইটি কার্ড

এক নাইমই পাচার করেছেন ৫০০ মানুষ
চক্রটির মূলহোতা নাইম খান ওরফে লোটাস

প্রথম নিউজ, ঢাকা: দুবাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানি বন্ধ করলেও দুবাই শ্রম বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা ছিল। সেখানকার কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্রমণ ভিসায় দুবাইয়ে অবস্থানকারীদের ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে কাজের বৈধতা দিচ্ছিল। ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুবাইয়ে শ্রমশক্তি পাঠানোর নামে গত সাত বছরে অবৈধভাবে পাঁচ শতাধিক মানুষকে পাচার করেছে নাইম খান ওরফে লোটাস (৩১)।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া বিদেশ যাওয়া যায় না। এজন্য চক্রের মূলহোতা দুবাই প্রবাসী নাইম ভুয়া বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড তৈরি করে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীকে অবৈধভাবে বিদেশ পাঠাতে চেয়েছিল। যা ধরা পড়ে যায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগে। বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড নকল হিসেবে শনাক্ত করে এবং ভিকটিমদের বিদেশ যাত্রা স্থগিত করে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে র‌্যাব-৩ ছায়া তদন্ত শুরু করে। র‌্যাব-৩ এর একাধিক দল রাজধানীর তুরাগ, উত্তরা, রমনা, পল্টন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকায় গত রাত থেকে আজ (শনিবার) সকাল পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে মানবপাচার চক্রটির মূলহোতা নাইম খান ওরফে লোটাস (৩১) সহ আট জনকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার অন্যরা হলেন- নুরে আলম শাহরিয়ার (৩২), রিমন সরকার (২৫), গোলাম মোস্তফা সুমন (৪০), বদরুল ইসলাম (৩৭), খোরশেদ আলম (২৮), মো. সোহেল (২৭) ও মো. হাবিব (৩৯)। এসময় তাদের কাছ থেকে ১৪টি পাসপোর্ট, ১৪টি নকল বিএমইটি কার্ড, একটি সিপিইউ, একটি প্রিন্টার, একটি স্ক্যানার, দুই বক্স খালি কার্ড, পাঁচটি মোবাইল ফোন, একটি চেক বই, পাঁচটি নকল সিল উদ্ধার করা হয়।

আজ শনিবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৩ অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল রকিবুল হাসান।

তিনি বলেন, কয়েকজন ভুক্তভোগী র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে অভিযোগ করেন একটি চক্র তাদের ভ্রমণ ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া অবৈধভাবে বিদেশ যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে টাকা ফেরত চান তারা। তখন মানবপাচারকারী চক্র নকল বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড তৈরি করে ভিকটিমদের সরবরাহ করে। ওই নকল কার্ড নিয়ে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন করতে গেলে বিমানবন্দরে কর্তব্যরত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সদস্যরা ভিকটিমদের ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড নকল হিসেবে শনাক্ত করেন এবং তাদের বিদেশ যাত্রা স্থগিত করেন।

জিজ্ঞাসাবাদে ও অনুসন্ধানে জানা যায়, নাইম খান ওরফে লোটাস (৩১) চক্রটির মূলহোতা। তিনি দুবাই প্রবাসী। চলতি বছরের মে মাসে তিনি দেশে ফেরত আসেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস। তিনি ২০১২ সালে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে দুবাই গমন করেন।

পরে দুবাই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানি করা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু দুবাই শ্রম বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা থাকায় দুবাইয়ের কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্রমণ ভিসায় সেখান অবস্থানকারীদের ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে কাজের বৈধতা দেয়। ওই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নাইম মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ে।

নাইম দুবাইয়ে ও বাংলাদেশে তার পরিচিতদের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দুবাই যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। ভুক্তভোগীরা রাজি হলে দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের ভ্রমণ ভিসায় দুবাই নিয়ে যান নাইম। তবে ভ্রমণ ভিসায় যাওয়ার পর তাদের কেউ কেউ কাজের সুযোগ পেলেও অধিকাংশই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এভাবে তিনি সাত বছর ধরে পাঁচ শতাধিক মানুষকে দুবাই পাচার করেছেন। মানবপাচার থেকে অর্জিত অবৈধ উপার্জন দিয়ে তিনি দুবাইয়ে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেয় এবং নিজে রেসিডেন্স ভিসার অনুমোদন নেয়।

জিজ্ঞাসাবাদে নাইম র‌্যাবকে জানায়, দুবাইয়ে ফারুক নামে তার একজন সহকারী রয়েছে এবং নুরে আলম শাহরিয়ার বাংলাদেশে তার মূল সহযোগী হিসেবে কাজ করে। শাহরিয়ার মূলত যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে দেয়। শাহরিয়ারের কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান রয়েছে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেই ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন।

সম্প্রতি কিছু ভুক্তভোগী বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া বিদেশ যেতে অস্বীকৃতি জানালে শাহরিয়ারের মাধ্যমে বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্র মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়।

বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্রের মূলহোতা হাবিব এবং খোরশেদ। তারা দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত গোপনে নিজেদের আড়ালে রেখে বিশ্বস্ত জনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের নকল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে নাইম বিএমইটি কার্ড ছাড়াই মানবপাচার করে আসছে। ভুক্তভোগীরা বিএমইটি কার্ড দাবি করলে শাহরিয়ার তার চাচা গ্রেফতার গোলাম মোস্তফা সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি একটি বিএমইটি কার্ড দেন। নাইম ভুক্তভোগীদের বিএমইটি কার্ড সংগ্রহ করার জন্য শাহরিয়ারের মাধ্যমে ১৩টি পাসপোর্ট সুমনের কাছে হস্তান্তর করেন। শাহরিয়ারের নির্দেশেই জাল বিএমইটি কার্ড সুমনের কাছে থেকে সংগ্রহ করে নাইমের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

জাল বিএমইটি কার্ড তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হাবিব জানায়, তিনি মহসিন নামের একজনের কাছ থেকে খালি কার্ড কিনে আনেন। প্রকৃত বিএমইটি কার্ড স্ক্যান করে তিনি নিজেই গ্রাফিক্স করেন। তারপর ভিকটিমের পাসপোর্টে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কার্ডের পেছনে তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয় এবং বদরুলের নির্দেশমতো রিক্রুটিং লাইসেন্সের নাম্বার বসিয়ে দেওয়া হতো। তিনি চার বছর ধরে ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ডের ডিজাইন এবং প্রিন্টের ব্যবসা করে আসছেন।

অভিজ্ঞতা থেকে তিনি কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থের বিনিময়ে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নকল কার্ড তৈরি করে সরবরাহ করে আসছিলেন। মানবপাচারকারী চক্র ও বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্রের ফাঁদে পড়ে অসংখ্য ভুক্তভোগীর বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থানায় মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের এ কর্মকর্তা।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

This site uses cookies. By continuing to browse the site you are agreeing to our use of cookies & privacy Policy from www.prothom.news