চুরিতেই ‘শেষ’ ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা
প্রতিনিয়ত চুরি হতে থাকে মালামাল।
প্রথম নিউজ, সিলেট: ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর বন্ধ হয়ে যায় ফেঞ্চুগঞ্জ ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি (এনজিএফএফ) লিমিটেড। বন্ধের পর কারখানাটিতে যেন শুরু হয় হরিলুট। প্রতিনিয়ত চুরি হতে থাকে মালামাল।
সার কারখানাটি বন্ধের পর থেকে কয়েকশ স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ীর আনাগোনা ছিল সেখানে। চোরাই মালামাল বিক্রি করে কপাল খুলেছে কারখানার ভেতর ও বাইরের অনেকের।
কারখানার আবাসিক কলোনির শত শত বসতঘর স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের কাছে বিক্রি করা হয়। লাখ লাখ ইট, টিন, লোহা ও কাঠের দরজা, জানালা ও ধাতব বস্তুসহ মূল্যবান জিনিসপত্র বিক্রি করে জড়িত অনেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে ওই সার কারখানায় বড় ধরনের চুরি হয়। সার কারখানার ভেতর থেকে ৬২ ধরনের লৌহজাত সামগ্রী লাল কন্টেইনারে (নং-চট্ট মেট্রো ই-৮১-০২১৬) বোঝাই করে পাচার করা হয়। চোরাই মালামালসহ হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থেকে চালক হারুন ও ক্রেন অপারেটর মজিদকে আটক করে পুলিশ। এই ঘটনায় মামলাও হয়েছিল। কিন্তু ভেতরে জড়িতদের শনাক্ত করতে না পারায় থেমে থাকেনি চুরি।
সেই সময় থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ বিলুপ্ত সার কারখানার গুরুত্বপূর্ণ মালামাল চুরি হয়ে হয়ে আসছে। নিরাপত্তা প্রহরী থাকা স্বত্বেও বারবার সংঘটিত চুরির ঘটনা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে কর্মকর্তাদের। পরে পুরোনো সার কারখানা ঘিরে সিসি ক্যামেরা লাগালেও সর্ষের ভূত তাড়ানো যায়নি। ২০১৬ সালের ৩০ জুন কারখানাটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এরপরই এসএস পাইপ, তামার তারসহ অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র উধাও হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে ভেতরে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সুইচ বোর্ড ও টারবাইনের তামার তার খুলে নেওয়া হয়। এমনকি পাওয়ার প্ল্যান্টের ভেতরের সুইচ বোর্ডগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ সার্কিট, তার, এসএস পাইপ চুরি হয়ে যায়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার চুরি থামছেই না। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয় এ পুরনো সার কারখানার স্ক্র্যাপ মালপত্র অপসারণের লক্ষ্যে এনজিএফএফ স্ক্র্যাপ ডিসপোজাল কমিটি নামের উচ্চ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ১০ সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করে। কিন্তু কমিটি তিনবার টেন্ডার দিয়েও কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি।
এদিকে বিকল্প হিসেবে পার্শ্ববর্তী স্থানে নতুনভাবে স্থাপিত শাহজালাল সার কারখানার অধীনে এই প্রতিষ্ঠানের সব জনবল ন্যস্ত করা হয়। বিসিআইসির ব্যবস্থাপনাধীন নতুন শাহজালাল সার কারখানাটি বর্তমানে পুরোদমে উৎপাদনে আছে। কিন্তু পুরাতন সার কারখানার মালামাল অপসারণ না হওয়ায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা মূল্যবান মালামাল খোয়া গেছে। প্রায় দশ বছর ধরে বন্ধ কারখানাটিতে অবশিষ্ট মূল্যবান মেশিনারিজ অযত্নে-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে।
সার তৈরির মেশিন প্রিলিং টাওয়ার, ইউরিয়া, অ্যামোনিয়া, অ্যামোনিয়াম সালফেট প্লান্ট, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বয়লার, গোডাউন, যানবাহন, পানি সরবরাহ শাখা স্টোরসহ কারখানার প্রতিটি যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ছে। মূল্যবান মালামাল চুরির ঘটনায় ফেঞ্চুগঞ্জ থানায় একাধিক মামলা হয়েছে। চুরির ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বিভিন্ন সময় ১০ জনকে আটক করে পুলিশ।
গত এপ্রিলে সার কারখানার চোরাই পাইপসহ অয়েছ নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। বিভিন্ন সময়ে চুরির এসব ঘটনা প্রভাব ফেলছে সারকারখানার দরপত্রে। এই পর্যন্ত তিনবার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু মালামাল চুরি হওয়ার তথ্য জানার পর অংশগ্রহণকারীরা টাকা দিতে ব্যর্থ হন বা অপারগতা প্রকাশ করেন ফলে বারবার দরপত্র বাতিল করতে হয়েছে। এ ঘটনায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়। এ অবস্থায় আবারো এলটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু এটিও কতটুকু কার্যকর হবে, এ নিয়ে নানা গুঞ্জন রয়েছে।
এ বিষয়ে শাহজালাল সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জিয়াবুল হোসেন বলেন, বিগত দিনে চুরির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে শুনেছি। এসব ঘটনা মামলাও হয়েছে। চুরি ঠেকাতে বর্তমানে নিরাপত্তায় চারটি সিকিউরিটি টিম কাজ করছে। তিনি বলেন, বিগত তিনটি টেন্ডারে (দরপত্র) দর ভালো পেলেও অংশগ্রহণকারীরা টাকা দিতে না পারায় টেন্ডারগুলো বাতিল হয়।
কারখানা সূত্রে জানা যায়, সার কারখানাটির স্ক্র্যাপ মালপত্র সাতটি শ্রেণীতে ভাগ করে সব পণ্যে মোট মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৯৮ কোটি ৮৫ লাখ ৪৭ হাজার ৫২৩ টাকা। পরবর্তী সময়ে এসব মালামাল বিক্রির জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল।