তৃতীয় দিনেও সংঘর্ষ অব্যাহত, থাইল্যান্ড সীমান্ত থেকে পালিয়ে যাচ্ছে কম্বোডিয়ানরা

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে এখন ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে বিস্ফোরণের শব্দ। একজন কম্বোডিয়ান সৈন্য তাঁর শরীরে আটকে থাকা থাই আর্টিলারি শেলের শ্রাপনেল অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচারের অপেক্ষা করছিলেন। কম্বোডিয়ার ওদ্দার মিয়ানচে প্রদেশ এবং থাই প্রদেশ সুরিনকে পৃথককারী বিতর্কিত সীমান্তে প্রাচীন তা মোয়ান থম মন্দিরের কাছে থাই সেনাদের সাথে লড়াইয়ে তিনি আহত হন বলে জানান ওই সৈনিক। হাসপাতালের করিডোরে বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় ওই সৈনিক আল জাজিরাকে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলে যাচ্ছিলেন। তার স্ত্রী এবং ছেলে পাশে মেঝেতে বসে ছিলেন । আহত ওই সৈনিক বলেন, 'তারা প্রথমে আমাকে সামরিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তাদের কাছে এক্স-রে মেশিন ছিল না। যখন আমি আঘাত পাই, তখন আমার পোশাক শরীর থেকে উড়ে যায়। 'দ্বিতীয় আহত কম্বোডিয়ান সৈনিক বর্ণনা করেছেন যে কীভাবে থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তের আরেকটি বিতর্কিত স্থান, ক্রাবেই মন্দিরের কাছে যুদ্ধ করার সময় তার বাম কাঁধে গুলি লেগেছিলো।
বৃহস্পতিবার সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পরপরই থাই সেনাদের পিছু হটিয়ে কম্বোডিয়া দাবি করেছে যে তারা তা মোয়ান এবং তা ক্রাবেইয়ের আশেপাশের অঞ্চল এবং আরও ছয়টি বিতর্কিত স্থানের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে। যদিও এই দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি বলে দাবি আলজাজিরার । দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এই দুই প্রতিবেশীর ৮০০ কিলোমিটার (৫০০ মাইল) সীমান্তের অনেক এলাকার মতো, মন্দিরগুলোও দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত আঞ্চলিক দাবির কারণে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়ার মধ্যে শেষ বড় সীমান্ত সংঘর্ষ ঘটে ২০১১ সালে একাদশ শতাব্দীর প্রিয়াহ ভিহার হিন্দু মন্দিরের কাছে, যা কম্বোডিয়ার অন্তর্গত এবং ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। শনিবার বিকেল পর্যন্ত, সীমান্তের উভয় পাশে ৩০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। কর্তৃপক্ষের মতে, কম্বোডিয়ায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছে, যেখানে থাইল্যান্ডে প্রায় ২০ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। তিন দিনের লড়াইয়ে সীমান্তের উভয় পাশে বেসামরিক অবকাঠামোতেও বোমা হামলা হয়েছে।
'আমরা আমাদের জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছি '
কম্বোডিয়া সীমান্তের কাছে কামান এবং রকেট হামলা বেসামরিক নাগরিকদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। থাই সীমান্ত থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার (৩ মাইল) দূরে ওদ্দার মিঞ্চেতে অবস্থিত তার বাসা থেকে পালিয়ে আসা কম্বোডিয়ান গ্রামবাসী চেং ডিব বলেন -' আমার খালি নিজের বাসার কথা মনে পড়ছে। 'চেং ডিব বর্ণনা করেছেন যে কীভাবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি তার বাসা ছেড়েছিলেন এবং এখন সংঘর্ষ থেকে দূরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার সন্তানদের সাথে আশ্রয় নিয়েছেন। সীমান্ত এলাকা থেকে পালিয়ে আসা আরও কয়েক ডজন পরিবার ওই বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
চেং ডিবের কথায় , "যদি এভাবে গোলাগুলি চলতে থাকে আমরা জানি না আগামী দিনে কি হবে। 'বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর জন্য ইতিমধ্যেই খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে এবং অনিশ্চয়তা বাড়ছে। কারণ অনেকেই তাদের বাসা , গবাদি পশু এবং খামারের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন - কারণ এগুলোই কম্বোডিয়ার দরিদ্র সীমান্ত অঞ্চলের মানুষগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইন। বাস্তুচ্যুত কম্বোডিয়ানরা যেখানে জড়ো হয়েছিল, সেখানেও অনেকে একই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সরকারি কর্তৃপক্ষের সহায়তা সীমিত। স্থানীয় একজন গ্রামপ্রধান বলেন, বাসিন্দারা একে অপরকে সাহায্য করার জন্য চাল এবং অন্যান্য সরবরাহ সংগ্রহ করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী যুদ্ধ শুরু হওয়ার একদিন আগে তার পালানোর কথা স্মরণ করে বলেন, তার সম্প্রদায়ের কিছু সদস্য মাঠে কাজ করছিলো , ঠিক তখনই থাই সেনাবাহিনী একের পর এক বোমা ছুড়তে শুরু করে।
থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার মধ্যে তীব্র বিরোধ
স্থানীয় কর্মকর্তাদের মতে, সীমান্তবর্তী অনেক এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে প্রায় ১,৪০,০০০ থাই বেসামরিক লোক পালিয়ে গেছে অথবা তাদের বাড়িঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। থাই সেনাবাহিনী আটটি সীমান্তবর্তী জেলায় সামরিক আইন জারি করেছে। কম্বোডিয়ায় প্রিয়াহ ভিহিয়ার, ওদ্দার মিয়ানচে এবং পুরসাত প্রদেশে প্রায় ৩৮,০০০ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন। কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ডের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সীমান্ত বিরোধ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে (যার মধ্যে কিছু এক শতাব্দীরও বেশি পুরনো) মে মাসে থাই সেনাদের সাথে সংক্ষিপ্ত বন্দুকযুদ্ধে একজন কম্বোডিয়ান সৈন্য নিহত হওয়ার পর । কয়েক মাস ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কূটনৈতিক ও বাণিজ্য পদক্ষেপের পর, এই সপ্তাহের শুরুতে দুই দেশের মধ্যে বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চলে স্থলমাইনের আঘাতে বেশ কয়েকজন থাই সৈন্য আহত হওয়ার পর উত্তেজনা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। থাইল্যান্ড কম্বোডিয়ার সৈন্যদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে মাইন পুঁতে রাখার অভিযোগ এনেছে। নমপেন তা করার কথা জোরালোভাবে অস্বীকার করে দাবি করেছে যে, মাইনগুলো ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধের অবশিষ্টাংশ।
উভয় দেশই তাদের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে । বৃহস্পতিবার সকালে সরাসরি সংঘর্ষ শুরু হয়, উভয় পক্ষই প্রথম গুলি চালানোর জন্য একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছে। ওদ্দার মিয়ানচে প্রদেশে শুক্রবার সীমান্তের ওপার থেকে কম্বোডিয়ার দিকে মেশিনগান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং কামানের গোলাগুলির তীব্র বিনিময় ঘটে। কম্বোডিয়া থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের অভিযোগও করেছে - যা আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে নিষিদ্ধ - অন্যদিকে থাইল্যান্ড তার পক্ষ থেকে কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে বারবার হাসপাতাল সহ বেসামরিক এলাকায় দূরপাল্লার রকেট নিক্ষেপের অভিযোগ করেছে। থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাই বলেছেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন বেসামরিক নাগরিকদের উপর আক্রমণের অভিযোগে কম্বোডিয়া যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হতে পারে। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত থাইল্যান্ডের সশস্ত্র বাহিনীকে প্ররোচনা ছাড়াই, পূর্বপরিকল্পিত এবং ইচ্ছাকৃত আক্রমণ চালানোর জন্য অভিযুক্ত করেছেন। সবমিলিয়ে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘাত ক্রমেই আরো তীব্র হচ্ছে।
সূত্র : আলজাজিরা