মৌলিক সংস্কারে ২১ দফা প্রস্তাব সুজনের

প্রথম নিউজ, অনলাইন : সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করা না হলে সংস্কারের সুফল পাওয়া যাবে না। মৌলিক সংস্কার না হলে নির্বাচন হবে, কিন্তু গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটবে না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। যার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার তাগিদ দিয়েছেন। শনিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন আয়োজিত রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে নাগরিক সংলাপে এসব কথা বলেন- বক্তারা। এ সময় রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের জন্য ২১ দফা প্রস্তাব হালনাগাদ করার কথা জানায় সুজন, যা চূড়ান্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পেশ করা হবে।
দেশের নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তাবগুলো হালনাগাদ করার তথ্য তুলে ধরে সুজনের পক্ষে থেকে বলা হয়েছে, দ্বিকক্ষ সংসদ, মন্ত্রিপরিষদ ‘শাসিত’ সরকার, ক্ষমতার ভারসাম্য, সংসদ সদস্য প্রত্যাহার, মৌলিক অধিকারের পরিধি বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয় তাদের প্রস্তাবে স্থান পেয়েছে। সুজন সদস্য একরাম হোসেন এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারে ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করার লক্ষ্যে নাগরিক সংগঠন সুজন-এর পক্ষ থেকে কাঙ্ক্ষিত জাতীয় সনদের একটি খসড়া তৈরি করে জনমত যাচাইয়ের লক্ষ্যে অনেকগুলো সংলাপের আয়োজন করা হয়েছিল। এ সকল সংলাপ থেকে প্রাপ্ত নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতে সুজন প্রস্তাবিত জাতীয় সনদটি হালনাগাদ করেছে। আপনাদের মতামতের ভিত্তিতে তা চূড়ান্ত করা হবে এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পেশ করা হবে। সুজনের ২১ প্রস্তাবে যেসব বিষয় এসেছে তার মধ্যে কয়েকটির ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। সেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলোর মধ্যে আছে- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা। তবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ (উচ্চকক্ষের গঠন ও সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি), নারী আসন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, রাষ্ট্রের মূলনীতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন পদ্ধতিসহ আরও কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শেষে ৩১ জুলাই চূড়ান্ত জাতীয় সনদ প্রকাশ করার অঙ্গীকার রয়েছে ঐকমত্য কমিশনের, যার আলোকে আগামী জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সুজনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাবেক বিচারপতি এমএ মতিনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, স্থানীয় সরকার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদ, সাবেক সচিব এ. কে. এম আবদুল আউয়াল মজুমদার, নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি, বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনুভা জাবিন, নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার, গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়ক আবুল হাসান রুবেল প্রমুখ।
জাতীয় সনদের বিষয়ে সাবেক বিচারপতি এমএ মতিন বলেন, এই যে আমরা জাতীয় সনদ করলাম যে সনদ করলাম এটা যদি কেউ না মানে তাহলে কি হবে? আমার মনে হয় এটার মধ্যে একটা বিধান থাকতে হবে এটাই আমার সাজেশন যে, এই সনদের বিরুদ্ধে কোনো আইন হবে না, কোনো কনস্টিটিউশন হবে না, যা কিছুই হবে সাংঘর্ষিক যা কিছু সাংঘর্ষিক হবে ওটা বাতিল। কারণ হচ্ছে- আপনাদের আমাদের এই বিপ্লবটাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের উৎস। আমরা যে কিছু কাজ করছি তার লেজিটিসিটা আমরা পাচ্ছি বিপ্লব থেকে।
তিনি বলেন, বলতেই হবে যে আমাদের চার্টারে যদি থাকে বাইরে হাইকোর্ট যাবে, এইটাই আইন, কারণ এটাই জনগণের অভিপ্রায়। জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং এটাই সর্বোচ্চ আইন। জনগণ যা বলবে সেটাই আইন হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোকে দুই ভাগে করা হয়েছে। কতগুলো সংস্কার আইন বিধি পরিবর্তনের মাধ্যমে করা যাবে। রাজনীতিবিদদের এ ব্যাপারে দ্বিমতের সুযোগ খুব কম। সেগুলো সরকারকে দেয়া হয়েছে। শত শত সুপারিশ আছে যেগুলো বাস্তবায়ন করা যায়। আর কতগুলো সংস্কারে রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। সেগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মৌলিক সংস্কার না হলে নির্বাচন হবে, কিন্তু গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটবে না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না।
মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কথায় কথায় যেন সংবিধান পরিবর্তন করতে না পারে। তার জন্য সংখ্যানুপাতিকে উচ্চকক্ষের কথা। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার লাগাম টানতে হবে। আর প্রতিষ্ঠানে সঠিক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া না গেলে তা হবে পণ্ডশ্রম। ইতিমধ্যে ১০টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। বাকি বিষয়গুলোতেও ঐকমত্য হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
প্রতিবেদনের দেয়ার পরেও বাস্তবায়নের উদ্যোগ না থাকায় টিজিং শিকার হচ্ছেন দাবি করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, সবাই বলে রিপোর্ট দিলেন কী হলো? স্থানীয় সরকার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংবিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই জানিয়ে তিনি বলেন, তারা চারটি আইনের খসড়াও তৈরি করে দিয়েছেন। কেন এসব আইন প্রয়োজন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। স্থানীয় সরকারের জন্য একীভূত আইনের প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু এখন শুধু মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করছে ঐকমত্য কমিশন। তারা যেসব আইন প্রস্তাব করেছেন সেগুলো করে ফেলার দাবি জানান তিনি। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। নাগরিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নেই। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারে এখন চলছে প্রশাসকের কাল। নির্বাচন কবে হবে জানা নেই। নির্বাচনের কথা বলাই যাচ্ছে না।
ইসি’র সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি বলেন, ৫৩ বছরে জাতীয় ঐকমত্য দেখিনি। এবার যদি ঐকমত্য হয় এবং তার বাস্তবায়ন হয় তাহলে মানুষের জীবন দেয়া, গণ-অভ্যুত্থান আর দেখতে হবে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকলে একরকম আর ক্ষমতার বাইরে গেলে আরেক রকম। দলগুলোকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে দেখা যায়নি। আমরা আশা করি এবার দেশের স্বার্থে কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হবে। তিনি বলেন, সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক জায়গায় বসানো দরকার।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের জানিয়ে বিএনপি’র ফরিদপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, গত ১৫ বছরে আমার নামে হওয়া বেশির ভাগ মামলা হচ্ছে বাস, ট্রেন পোড়ানোর অর্থ হচ্ছে আমি একজন সন্ত্রাসী। শেখ হাসিনা আমাকে সন্ত্রাসী বানিয়েছে! তাহলে কি আমার দলের কোনো পদ বা ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার নেই? অবশ্যই সংস্কার প্রয়োজন। তার আগে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করতে হবে, বিচার বিভাগ, দুদককে সংস্কার করতে হবে। সিস্টেমকে সংস্কার করা না গেলে, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ করা না গেলে রাজনৈতিক দলগুলো ভেতরে যতই সংস্কার করুক আলটিমেটলি ফলাফল পাবো না। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা থাকতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, বৈপ্লবিক পরিবর্তন না এলেও যেগুলোতে ঐকমত্য এসেছে সেগুলো বাস্তবায়ন হলেও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সত্যিকার অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসবে।
সংসদে মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন হবে না দাবি করে এনসিপি নেত্রী ডা. তাসনুভা জাবিন বলেন, এগুলো বাস্তবায়ন করেই সংসদে যেতে হবে। এটা প্রি-পেইড। ওখানে গেলে তা টেকসই হবে না। আরেকজন এসে তা বাতিল করে দেবে। নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন না করে, গণতান্ত্রিক রূপান্তর না করে, নিয়ম সেট না করে সরকার গঠন করলে অবশ্যই বারবার গণ-অভ্যুত্থান হবে। এবার আর ১৫ বছর কেউ সময় নেবে না, তার আগেই টেনে ফেলে দেবে।
সংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের বিধান অবশ্যই নির্বাহী বিভাগের বাইরে রাখতে হবে বলে মনে করেন সাইফুল হক। তিনি বলেন, যেগুলো নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ারের প্রশ্ন নেই। সংস্কার বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতা নেই দাবি করে নুরুল হক নুর বলেন, একটা মেরুদণ্ড ভাঙা সরকার। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জনসমর্থিত সরকার গঠিত হয়েছিল। তারা কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে। কার্যত ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে যাচ্ছে। সংস্কারের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার সভার নির্বাচনের দাবি করেন আবুল হাসান রুবেল। তিনি বলেন, জনগণের ম্যান্ডেট নেয়া ছাড়া সংস্কার স্থায়ী হবে না।