অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে ধুঁকছে পুরো বীমা খাত

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা খাতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পুঞ্জীভূত মোট বকেয়া বীমা দাবির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৮৩৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৯ হাজার ৮২৮ কোটি টাকার দাবি পরিশোধ করা হয়েছে, যা পুঞ্জিভূত মোট বীমা দাবির ৫৮.৩৭ শতাংশ। এই হিসাবে ২০২৫ সালের শুরুতে দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা খাতে পুঞ্জীভূত বকেয়া বীমা দাবির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ১০ কোটি টাকা।
জীবন বীমা কোম্পানির অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে ধুঁকছে পুরো বীমা খাত। গ্রাহকের টাকা নিয়ে পালিয়েছেন অনেক এজেন্ট। তাদের দাবির টাকা বছরের পর বছর আটকে রাখছে বেশির ভাগ বীমা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ঘুরেও বীমা দাবির টাকা তোলা যাচ্ছে না। ফলে বর্তমানে তীব্র আস্থা সংকটে পড়েছে খাতটি। সবশেষ তথ্য বলছে, ৩৬ জীবন বীমা কোম্পানির ২৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬০৩টি দাবি উত্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে পরিশোধ হয়েছে ১৫ লাখ ৮২ হাজার ১৫২টি। অর্থাৎ এখনো ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫১টি বীমা দাবি অপরিশোধিত রয়েছে। তার মানে ৪৫ শতাংশ বীমা দাবি পরিশোধ হয়নি। এ অবস্থায় ১৫টি বীমা কোম্পানি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ সম্প্রতি এই অনিরীক্ষিত হিসাব প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে গত ১৫ মে লাইফ বীমা খাতের এবং ৮ এপ্রিল নন-লাইফের দাবি পরিশোধের তথ্য প্রকাশ করা হয়। তবে লাইফ বীমা খাতের একটি কোম্পানি বছরের শেষে নতুন ব্যবসা শুরু করায় কোম্পানিটির দাবি পরিশোধের কোন তথ্য নেই এই হিসাবে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বকেয়া বীমা দাবির এই হার অনেক বেশি। আর এ কারণেই মানুষের আস্থা সংকটে রয়েছে দেশের বীমা খাত। বীমার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াতে হলে বীমা দাবির পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরো জোরালো ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। একইসঙ্গে খাতটির প্রতি সরকারের সুদৃষ্টিও প্রয়োজন।
ভুক্তভোগীদের হাহাকার: বীমা দাবি না পাওয়া এক গ্রাহক রংপুর উপজেলার পীরগঞ্জের হাসানপুর গ্রামের বাসিন্দা খায়রুল ইসলাম। তিনি ২০১০ সালে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে ১০ বছরের মেয়াদি পলিসি নেন। এরপর ২০২০ সালে তার বীমার মেয়াদ পূর্ণ হয়। মেয়াদ শেষে খায়রুলের পাওয়ার কথা মোট ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। কিন্তু, মেয়াদপূর্তির পরও রফিকুলের টাকা পরিশোধ করছে না প্রতিষ্ঠানটি।
আরেক গ্রাহক দিনমজুর মোমিনুল ইসলাম বলেন, আমার বীমার মেয়াদ তিন বছর আগে পূর্ণ হয়েছে। তারপরও তারা আমাকে টাকা দিচ্ছে না। তিনি বলেন, এত কষ্টের টাকা ধীরে ধীরে জমিয়েছি। এখন এই টাকা পাবো কি না, জানি না। যখন বীমা করলাম, তখন তো ভেবেছিলাম যে এটা একদিন আমার উপকারে আসবে। কিন্তু তা তো হলো না। এখন দেখছি বীমা করে ভুল করেছি।
শীর্ষে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ: যে সব বীমা প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। গ্রাহকদের সবচেয়ে বেশি টাকা আটকে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের হাতে আটকা প্রায় ২ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। এর পরেই আছে সানফ্লাওয়ার লাইফ, বায়রা লাইফ, পদ্মা ইসলামী, গোল্ডেন লাইফ, হোমল্যান্ড ও প্রগ্রেসিভ ইন্স্যুরেন্স। এই সাত প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে প্রায় ১২ লাখ গ্রাহকের।
সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স: সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। কোম্পানিটি গ্রাহকের ১৭৬ কোটি টাকার দাবির মধ্যে ৯৯.২৮ শতাংশই পরিশোধ করেনি। একইভাবে বায়রা লাইফ, যাদের কাছে গ্রাহকের আটকা ৭৭ কোটি টাকার বেশি। প্রতিষ্ঠানটির দাবি পরিশোধ হার মাত্র ০.৭৩ শতাংশ। দাবি পূরণে ডিসেম্বরের মধ্যে আশ্বাস দিলেও কোম্পানির জমি বিক্রির কথায় সংকটের গভীরতা স্পষ্ট।
পদ্মা ইসলামী লাইফ: এস আলম গ্রুপের পদ্মা ইসলামী লাইফ ২৪০ কোটি টাকা দাবির বিপরীতে পরিশোধ করেছে মাত্র ১.৬৮ শতাংশ। গোল্ডেন লাইফ, হোমল্যান্ড ও প্রগ্রেসিভ লাইফেরও পরিশোধের হার ২ শতাংশের নিচে। এ ছাড়া সানলাইফ, ডায়মন্ড, প্রাইম ইসলামী, আকিজ তাকাফুল ও যমুনা লাইফ সহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও ২৫ থেকে ৭০ শতাংশ দাবি অনিষ্পন্ন রেখেছে। অর্থাৎ পরিশোধ করেনি।
৯০ দিনের মধ্যে গ্রাহককে টাকা দিতে হবে: আইডিআরএ’র হিসাব বলছে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩৬টি জীবন বীমা কোম্পানিতে মোট অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ ৬ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ হাজার কোটির বেশি এখনো ঝুলে আছে। অথচ বীমা আইন অনুসারে, পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের কাছে সব কাগজপত্র জমা দেয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বীমা দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। অর্থাৎ গ্রাহককে তার টাকা পরিশোধ করতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সব ধরনের বীমা দাবি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয় আইডিআরএ। এ ছাড়া, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশও আমলে নিচ্ছে না বীমা কোম্পানিগুলো।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: চলতি মাসে এক অনুষ্ঠানে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান আসলাম আলম বলেন, দেশে ব্যবসা করা ১৫টি জীবন বীমা কোম্পানি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত সীমার বেশি খরচ করেছে এবং নানাভাবে অর্থ অপচয় করেছে। তারা নিয়ম মানছে না, দাবি সময়মতো দিচ্ছে না, ফলে পুরো খাতে চরম আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ভারপ্রাপ্ত সিইও শহিদুল ইসলাম ফোন ধরেননি। তবে প্রতিষ্ঠানটির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েক বছরে কোম্পানির ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি লুট হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন অসুস্থ। বীমা দাবি দিতে না পারায় কোম্পানির অনেক বদনাম হয়েছে। নতুন করে আর কেউ পলিসি খুলছেন না। এতে করে বীমা দাবি পরিশোধের জন্য নগদ অর্থেরও সংকট তৈরি হয়েছে। জমি বিক্রি ছাড়া অন্য কোনো পথ আমাদের কাছে নেই। তিনি জানান, এর আগে বীমা দাবি পরিশোধের জন্য প্রতিষ্ঠানটি তাদের কেনা জমি বিক্রির চেষ্টা করেছে। কিন্তু সম্ভাব্য ক্রেতারা ক্রয়মূল্যের চেয়ে কম দাম দিতে চাওয়ায় তা বিক্রি করা যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, দাবির টাকা সময়মতো না দিলে মানুষ বীমার প্রতি আগ্রহ হারায়। এই আস্থাহীনতা জাতীয় অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রবন্ধে বলা হয়, রাজনৈতিকভাবে সরকারের অঙ্গীকার হয়তো পরিষ্কার। কিন্তু সেটা বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট সচেতন নয়। প্রাতিষ্ঠানিক পরিস্থিতির জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকবলও প্রস্তুত নয়। এই যে সামগ্রিকভাবে একটি ঘাটতি, এর সমাধান করতে হবে।
একসময় জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান ছিল প্রায় ১ শতাংশ। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ০.৪৫ শতাংশে। তবে, সব কোম্পানির চিত্র এমন নয়। আলফা ইসলামী, এলআইসি, মার্কেন্টাইল ও সান্তা লাইফ ইনস্যুরেন্স শতভাগ দাবি পরিশোধ করেছে। রূপালী, ট্রাস্ট ও সোনালী লাইফ দাবি করেছে ৯৯ শতাংশ পরিশোধের। গার্ডিয়ান, মেটলাইফ, স্বদেশ, মেঘনা, প্রগতি, সন্ধানী, বেস্ট লাইফসহ আরও অন্তত ১২টি কোম্পানি ৮০ থেকে ৯৮ শতাংশ দাবি পূরণ করেছে।