খেলাপি ঋণের সঠিক কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না
গতকাল রোববার সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: বছরের পর বছর রিশিডিউলিং করার কারণে খেলাপি ঋণের সঠিক কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে যে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে বাস্তবে আরও অনেক বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। এর কারণে ব্যাংকিং খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গেছে। পাশাপাশি দেশে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। অনেকে বিশ্বাস করেন না যে বাংলাদেশে কোনো নিয়মকানুন রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো যখন একটি নিয়ম-ভিত্তিক ব্যবস্থা বিদায় নেয়। মানুষ তখন প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান।
তিনি বলেন, আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই বুঝতে চাই যে আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও কেন পাকিস্তানের তুলনায় বৈদেশিক বিনিয়োগ কম, তাহলে আমাদের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতির কারণ তদন্ত করা উচিত গতকাল রোববার সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘ইজ দ্য বাংলাদেশ প্যারাডক্স সাসটেইনেবল?’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষ্যে এ আয়োজন করে সানেম। বইটি সম্পাদনা করেছেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, ড. ফ্রাসোঁয়া বুরগনিওন এবং ড. উমর সালাম। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে এটি প্রকাশ হয়েছে। ড. রেহমান সোবহান আরও বলেন, প্রবৃদ্ধির কথা বিবেচনা করার সময়, আমরা শুধু বাংলাদেশের প্যারাডক্সই নয়, ভিয়েতনাম এবং চীনের প্যারাডক্সও লক্ষ করি। অত্যন্ত দুর্বল প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও তারা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের নিয়ম-ভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার, ব্যক্তি-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নয়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের ব্যাংকিং খাতে ‘ডিল’ করা হয়। যাদের রাজনৈতিক পরিচয় আছে, মামা-চাচা, ভাই-বোন আছে তারা সহজেই ঋণ পাচ্ছেন। আবার খেলাপি হয়েও বহাল তবিয়তে আছেন। এক্ষেত্রে সব জায়গায় একটা ডিল করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন দুদকের সঙ্গে ডিল করে অনেক প্রভাবশালী নিষ্পাপ শিশুর সনদ পেয়ে যাচ্ছেন। আবার রাজস্ব খাতে ডিল বেজ অনেক কিছুই হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ডিল অনুযায়ী অনেককে সুবিধা দিয়ে থাকে। এটা ঠিক নয়। এসব কারণে কেউ সুযোগ পায়, কেউ পায় না। ফলে বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশে ৬ শতাংশের উপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও আইনকানুন না মানা এবং কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অনুপস্থিতিতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসছে না।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। অতিথি ছিলেন প্রফেসর ড. রেহমান সোবহান এবং যুক্তরাজ্যের উলস্টার ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. এসআর ওসমানি। সেমিনারে ড. সেলিম রায়হান এবং ড. উমর সালাম বইটির উপরে আলোচনা করেন। তাদের বক্তব্য শেষে উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক এমএম আকাশ, ড. মির্জা এম হাসান, ড. কাজী মারুফুল ইসলাম, ড. মনজুর হোসেন এবং ড. সায়েমা হক বিদিশা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মসিউর রহমান ট্যাক্সের বৈধতা এবং কার্যকরভাবে ট্যাক্স সংগ্রহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্রের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, কর নীতিগুলোও যাচাইয়ের আওতায় আসা উচিত। সম্পূরক শুল্ক এবং মূল্য সংযোজন, সেইসঙ্গে রাজস্ব বৃদ্ধি করার আগে আবগারি শুল্কের আরও সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ প্রয়োজন। টার্নওভার ট্যাক্স সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, এই বইটি বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রায় আড়াই বছরের গবেষণার ফলাফল। অনেক সাব-সাহারান দেশের তুলনায় দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক গুণমান সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। বইটির প্রথম অধ্যায়ে বাংলাদেশের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ডায়াগনস্টিক কাঠামো, অংশীজনদের জরিপ এবং বৈশ্বিক সূচক উপস্থাপন করা হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে প্রাথমিক শিক্ষা, রপ্তানি বৈচিত্র্য, ব্যাংকিং খাত এবং ভূমি প্রশাসনে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে। সবশেষে, একটি অধ্যায়ে সম্পাদকরা এই চ্যালেঞ্জগুলোকে সামগ্রিকভাবে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য একটি ডায়াগনস্টিক টুল তৈরি করেন।
বইটিতে প্রতিটি অধ্যায় শেষে সম্পাদকদের নিজের লেখার পাশাপাশি অন্যান্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য এবং আলোচনা রয়েছে।
সেলিম রায়হান বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত হওয়া উন্নয়নের পেছনে ভ‚মিকা রাখা বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন রাখেন- বাংলাদেশ কি উন্নয়নের পরের ধাপে যেতে একই ধরনের পদ্ধতি (গ্রোথ ড্রাইভারস) ব্যবহার করতে পারবে? তিনি বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর হলো ‘না’। কেননা বাংলাদেশ অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের একটি পকেট এবং একটি রাজনৈতিক মীমাংসা প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করেছে যা এই গ্রোথ ড্রাইভারদের সুবিধা দেয়। প্যারাডক্সের পেছনে এটি প্রধান কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন, যার কারণে উন্নয়ন ভবিষ্যতে টেকসই নাও হতে পারে।
বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত খুবই কম, যার ফলে রাজস্ব-উৎপাদনকারী বাজেট বেশ কম এবং প্রস্তাবিত বাজেটের অংশমাত্র বাস্তবায়িত হয়। তিনি বলেন, আমাদের দেশে একটি শক্তিশালী সংস্কারবিরোধী জোট রয়েছে, যারা দুর্নীতির চক্রকে ভাঙতে বাধা দেয়। নতুন গ্রোথ ড্রাইভারস পেতে বাংলাদেশের বেশ কিছু পদক্ষেপ দরকার বলেও তিনি উল্লেখ করেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘সমন্বিত শিল্প নীতি, রাজনৈতিক সমন্বয়, ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়ন, ট্যাক্স খাতের উন্নয়ন, বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভার্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মীর্জা এম হাসান বলেন, বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং খাতে যা ঘটছে তা নিয়ে খুব বেশি কিছু গোপন নেই। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ব্যাংকিং খাতে ক্যাপিটালের যুক্তির আধিপত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উদার পুঁজিবাদের দিকে যাচ্ছে, নাকি চীনের মতো রাজনৈতিক পুঁজিবাদের দিকে যাচ্ছে? এক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশে ডমিন্যান্ট পার্টি স্টেটের একটি খুব দ্রুত আত্তীকরণ দেখতে পাচ্ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফ বলেন, বিচারিক ব্যবস্থার অধ্যায়ে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি কেন এত লোক তাদের জমি হারায়। আদালত সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অসংখ্য মামলা রয়েছে। প্রায় ৪০ লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স আশ্চর্যজনকভাবে ভালো। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের অভাবকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার বলেন, আজ ৫০ বছর পরে দেখি বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশ আমাদের অর্থনীতিকে সফল হিসাবে চিহ্নিত করেন। বাংলাদেশি শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমকে কৃতিত্ব দিয়ে তিনি বলেন, প্যারাডক্স হিসাবে চিহ্নিত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ উন্নয়নে আমাদের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স অনেক বেশি অবদান রাখছে। এজন্য পোশাক খাত ও এর বাইরে অন্য রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে বহুমুখীকরণ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে স্বায়ত্তশাসন দরকার। নেতিবাচক শক্তি প্রায়ই ইতিবাচক শক্তিকে ছাপিয়ে যায়। ফলে সংস্কারকে কঠিন করে তোলে। রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতার গতিশীলতা বোঝার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক গতিশীলতার ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক বিবেচনা তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. মঞ্জুর হোসেন বলেন, যদি প্যারাডক্স থাকে, একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকা উচিত যখন প্যারাডক্সটি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ যদি মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জন করতে পারে, তাহলে এই প্যারাডক্স টিকে থাকতে পারবে না। নিও-ক্লাসিক্যাল পরিস্থিতি বিবেচনা করলে, রাজনৈতিক শাসন প্রাতিষ্ঠানিক পরিস্থিতির ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ, বাণিজ্য উদারীকরণের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান ওসমানি মেথোডলজির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে বলেন, প্রকল্পটিতে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যকরী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে তেমন আলোচনা করা হয়নি। যে প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে ভালোভাবে কাজ করছে সেগুলো নিয়ে কেন আমরা আলোচনা করি না? বাংলাদেশের প্যারাডক্সের চেয়েও এটি আরও বেশি প্যরাডক্সিক্যাল। আমাদের অবশ্যই একই সঙ্গে কার্যকর এবং অকার্যকর উভয় প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে কাজ করতে হবে।