করপোরেট সিন্ডিকেটেই বন্দি সয়াবিন তেল

করপোরেট সিন্ডিকেটেই বন্দি সয়াবিন তেল
করপোরেট সিন্ডিকেটেই বন্দি সয়াবিন তেল

প্রথম নিউজ, অনলাইন:   দেশে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে দেশের ভোজ্যতেলের বাজার। সংকটের সময় বরাবরই এই সিন্ডিকেটের দিকেই থাকে আঙুল। রোজার আগে এবারও বাজারে কৃত্রিম সরবরাহ সংকট তৈরি করে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশিতে বিক্রি করা হচ্ছে সয়াবিন তেল। আবার সেই তেল কিনতে সঙ্গে নির্ধারিত অন্য পণ্যও নেওয়া করা হয়েছে বাধ্যতামূলক।

বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম মহানগরীর কয়েকটি বাজার সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রান্তিক ভোক্তা পর্যায়ের মুদি দোকানে সয়াবিন তেলের সংকট। অধিকাংশ মুদি দোকানে মিলছে না বোতলজাত সয়াবিন তেল। বেচাকেনা বেশি এমন মুদি দোকানে সয়াবিন তেল মিললেও সঙ্গে বাধ্যতামূলক নিতে হচ্ছে অন্য ভোগ্যপণ্য। অনেক দোকানে সাধারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে সয়াবিন তেল। মূলত নিয়মিত গ্রাহকরাই কিছুটা পাচ্ছেন।

    প্রায় সব কোম্পানিই ডিলারদের শর্ত দিয়েছে, তেলের সঙ্গে স্লো আইটেম নিতে হবে। কোম্পানিভেদে প্রত্যেকের অন্য প্রোডাক্ট চাল, চা-পাতা, সরিষার তেল, মুড়ি, পানি রয়েছে। তাদের কাছ থেকে তেল নিতে হলে এসব স্লো আইটেম নিতে হচ্ছে।- মুদি দোকানি মো. কায়সার

নগরীর ব্যস্ততম এলাকার একটি হালিশহর। হালিশহর বড়পোল এলাকার মুদি দোকানি খন্দকার এন্টারপ্রাইজ। বুধবার সকালে ওই দোকানে গিয়ে পাওয়া যায় তীর ব্র্যান্ডের ৫ লিটারের সয়াবিন তেল। ওই তেলের বোতলের সঙ্গে একই গ্রুপের এক কেজি চিনিগুঁড়া চালের প্যাকেট স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো।

খন্দকার এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী রাসেল বলেন, ‘সয়াবিন তেল বাজারে নেই। আমাদের ৫ লিটারের চার বোতল সয়াবিন তেলের একটি কার্টনের সঙ্গে ডিলার ১০ কেজি চিনিগুঁড়া চাল দিচ্ছেন। এমনিতেই সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের নিয়মিত অনেক গ্রাহক আছেন। তাদের জন্যই সয়াবিন তেল রাখতে হয়।
৫ লিটার সয়াবিন তেল ও এক কেজি চিনিগুঁড়া চালসহ এক হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৮৫০ টাকা তেলের দাম, ১৫০ টাকা চালের দাম।’

পাশের মেসার্স বেলাল স্টোরের মালিক মো. বেলাল বলেন, ‘রূপচাঁদা, পুষ্টি, তীর সবগুলো কোম্পানি চাল ছাড়া তেল (সয়াবিন) দিচ্ছে না। আমরাও বাধ্য হয়ে চালসহ তেল কিনছি। চাল না নিলে ডিলার থেকে আমাদের তেল দেওয়া হয় না। ৫ লিটার তেল কোম্পানির ডিলার থেকে আমরা ৮৪২ টাকায় কিনি, ৮৫০ টাকায় বিক্রি করি। সঙ্গে বাধ্য হয়েই এক কেজি চিনিগুঁড়া চাল ১৫০ টাকা মিলে এক হাজার টাকায় তেল ও চাল বিক্রি করছি।’

করপোরেট সিন্ডিকেটেই বন্দি সয়াবিন তেল

একসময়ে আমাদের দেশে ভোজ্যতেল হিসেবে রান্নার জনপ্রিয় বড় অনুষঙ্গ ছিল সরিষার তেল। স্থানীয় পর্যায়ে সরিষা মাড়াই করে তেল পাওয়া যেত। সময়ের ব্যবধানে বিগত তিন দশকে সরিষা তেলের আধিপত্যে ভাগ বসায় আমদানিনির্ভর সয়াবিন তেল। বর্তমানে দেশে হাতেগোনা কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে সয়াবিন তেলের ব্যবসা।

    পুরো বাজার ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটের দখলে। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উপদেষ্টাদের কোনো বক্তব্য নেই। বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ লাখ লাখ টন সয়াবিল তেল আমদানি হয়েছে। মিলারদের গোডাউনে সয়াবিন তেল রয়েছে। তারা সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রেখেছে।- ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন

ভোজ্যতেল বাদেও এসব করপোরেট প্রতিষ্ঠানের রয়েছে চাল, ডালসহ বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার খোলাবাজারে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দিলেও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তেলের সঙ্গে অন্য ভোগ্যপণ্য বিক্রির কৌশলে প্রতিনিয়ত ঠকছেন ভোক্তারা।

বর্তমানে বাজারে শিল্প গ্রুপ সিটি গ্রুপের ‘তীর’, মেঘনা গ্রুপের ‘ফ্রেশ’, টিকে গ্রুপের ‘পুষ্টি’, আবুল খায়ের গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান স্মাইল ফুড প্রোডাক্টসের ‘স্টারশিপ’, বসুন্ধরা গ্রুপের ‘বসুন্ধরা’ এবং বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানির ‘রূপচাঁদা’ ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল রয়েছে।

নগরীর আরেক ব্যস্ততম এলাকা কাজীর দেউড়ি। ওই এলাকার মুদি দোকানি খান ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ম্যানেজার মো. কায়সার বলেন, ‘প্রায় সব কোম্পানিই ডিলারদের শর্ত দিয়েছে, তেলের সঙ্গে স্লো আইটেম নিতে হবে। কোম্পানিভেদে প্রত্যেকের অন্য প্রোডাক্ট চাল, চা-পাতা, সরিষার তেল, মুড়ি, পানি রয়েছে। তাদের কাছ থেকে তেল নিতে হলে এসব স্লো আইটেম নিতে হচ্ছে।’

করপোরেট সিন্ডিকেটেই বন্দি সয়াবিন তেল

তিনি বলেন, ‘৫ কার্টন তেল নিতে হলে চিনিগুঁড়া চালের সঙ্গে সরিষার তেল নিতে হবে, না হয় চা-পাতা। আমাদের নিয়মিত গ্রাহকের স্বার্থে বাধ্য হয়েই ডিলারদের কাছ থেকে স্লো আইটেমসহ তেল নিতে হচ্ছে। আমরাও বাধ্য হয়েই গ্রাহকের কাছে এসব আইটেম দিয়েই তেল বিক্রি করছি। অনেক সময়ে তেলের বোতলের চেয়ে স্লো আইটেম বেশি দিচ্ছে ডিলাররা।’

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার চার মাস পর ৯ ডিসেম্বর সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ৮ টাকা বাড়ানো হয়। ওইদিন ঢাকার সচিবালয়ে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সয়াবিন তেল ও পাম তেলের নতুন দাম ঘোষণা করেন। পরদিন ১০ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয় ওই দাম।

প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা, খোলা সয়াবিন ১৪৯ থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা। খোলা পাম তেলের দাম লিটারে ১৪৯ থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করা হয়। এছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৮৬০ টাকা, যা আগে ছিল ৮১৮ টাকা। ওই বৈঠকে অংশ নেন ভোজ্যতেল প্রস্তুতকারক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার।

মোস্তফা হায়দার দেশের শীর্ষ শিল্প গ্রুপ টিকে গ্রুপের পরিচালক, তাদের কয়েকটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও তিনি। ভোজ্যতেলের বাজারের বড় অংশীদার টিকে গ্রুপ। বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট নিয়ে জানতে মোস্তফা হায়দারকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা দেওয়া হলেও কোনো সাড়া দেননি।

নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকার মুদি দোকানগুলোতে পণ্য সরবরাহ করেন রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের ডিলার মেসার্স জায়ান এন্টারপ্রাইজ। জায়ান এন্টারপ্রাইজের হয়ে বিপণনে কাজ করেন বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি (এসআর) মো. ফিরোজ। জানতে চাইলে মো. ফিরোজ বলেন, ‘খুচরা দোকানিরা যেভাবে বলছেন, বিষয়টি তেমন নয়। মূলত আমাদের সয়াবিন তেল বাদেও আরও আট-দশটি প্রোডাক্ট রয়েছে। আমরা দোকানে স্লিপ কাটতে গেলে দোকানদারদের অন্য প্রোডাক্টগুলো নেওয়ার অনুরোধ করি, কিন্তু বাধ্য করা হয় না।’

কাস্টমস ও বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসেই অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে প্রায় চার লাখ টন। এর মধ্যে ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন নিয়ে আসা ‘এমভি সুবরা’ জাহাজাটি খালাস শেষে ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করেছে। তাছাড়া ব্রাজিল, আমেরিকা, কানাডা, আর্জেন্টিনা থেকে পাঁচটি জাহাজে আসা ২ লাখ ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত ভোজ্যতেল খালাস হচ্ছে।

করপোরেট সিন্ডিকেটেই বন্দি সয়াবিন তেল

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন  বলেন, ‘পুরো বাজার ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটের দখলে। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উপদেষ্টাদের কোনো বক্তব্য নেই। বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ লাখ লাখ টন সয়াবিল তেল আমদানি হয়েছে। মিলারদের গোডাউনে সয়াবিন তেল রয়েছে। তারা সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রেখেছে।’

তিনি বলেন, ‘সামনে রমজান। রমজান সামনে রেখে সয়াবিন তেলের আরেক দফা দাম বাড়ানোর অপকৌশল হচ্ছে বাজারে কৃত্রিম সংকট। সরকারের উচিত বাজারে মনিটরিং জোরদার করা। আমদানিকারক মিলারদের গোডাউনে তদারকি বাড়ানো। এতে ভোক্তাদের কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলবে।’