ঈদের আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি
গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানায় এই নেটওয়ার্ক।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরাসহ সব ব্যক্তির মুক্তির দাবি জানিয়েছে ‘ডিএসএ ভিকটিমস নেটওয়ার্ক।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সংগঠনটির পক্ষ থেকে আইনটি বাতিলের দাবিও জানানো হয়েছে। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানায় এই নেটওয়ার্ক।
এ সময় সংগঠনের সদস্য সচিব প্রীতম দাশ লিখিত বক্তব্যে বলেন, দেশের নাগরিকদের ডিজিটাল মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিতের তথাকথিত অজুহাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ তৈরি করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছর ধরে আমরা দেখতে পাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোনো ধরনের নিরাপত্তা বিধান করছে না। বরং এই আইনের মাধ্যমে বিরুদ্ধ মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে খর্ব করা হচ্ছে। এই আইন হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের লুটপাট, পাচার ও জুলুমের হাতিয়ার। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও এই আইনে আক্রান্ত হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশের সকল মানুষকে অনিরাপদ করে তুলেছে।
তিনি বলেন, সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৭ হাজার ১টি মামলা করা হয়েছে। ডিএসএ ভিকটিমস নেটওয়ার্ক সর্বশেষ ১ হাজার ৩৩১টি মামলার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দেখেছে, এসব মামলায় ৪ হাজার ১৬৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। সর্বোচ্চ মামলা হয়েছে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ৪৩১টি। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৬৮টি এবং শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৩৪টি।
এটা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, সমাজকর্মী এমনকি ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দমন পীড়নের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এই আইনের প্রয়োগই ভয়াবহ অপপ্রয়োগ। সরকার ও তার সংস্থাগুলো এই আইনকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট নিপীড়নমূলক একাধিক নতুন আইন বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এর আগের তথ্য প্রযুক্তি আইনেও অনেকে এখনো জুলুমের শিকার হচ্ছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। গত বছর গুজব রটিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে প্রীতম দাশ ও ঝুমন দাশ আপনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেপ্তার করা হয়। একইভাবে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার তথাকথিত অভিযোগে মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকের উপর এই আইনে মামলা ও গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাবের হেফাজতে মারা যাওয়া সুলতানা জেসমিনের ওপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছিল। এ আইনে দীর্ঘ ১০ মাস বিনা বিচারে আটক থাকা অবস্থায় জেলে মারা গেছেন লেখক মুশতাক আহমেদ। সংবাদপত্রে মাছ, মাংস ও চালের স্বাধীনতা বিষয়ক প্রতিবেদন করার কারণে সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে ডিএসএ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি বলেন, এই কালো আইনে দীর্ঘ ১০ মাস ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা কারাগারে রয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী মো. ইছমাইল, মো. তরিকুল ইসলামসহ অসংখ্য মানুষ দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাগারে আটক রয়েছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফলে আন্তর্জাতিক মহলে চরম সমালোচনা ও চাপের মুখে পড়ায় সরকার এটিকে সংশোধনের কথা বলছেন। আমরা দাবি করি এই গণবিরোধী দমন পীড়নের আইনটিকে সংশোধন নয়, পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। যেকোনো মাত্রায় এই আইন বিরাজমান থাকলে তা দেশের নাগরিকদের ন্যূনতম মত প্রকাশের অধিকারকে মারাত্মক হুমকিতে রাখবে। আমরা এই সংবাদ সম্মেলন থেকে ঈদের আগেই খাদিজা, ইছমাইল, তারিকুলসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দি সকলের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। একইসঙ্গে অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সকল নিপীড়নমূলক আইন বাতিল করতে হবে। সকল ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মিথ্যা মামলাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। এবং সরকারের এমন নিপীড়নমূলক আইন বানানোর একচ্ছত্র ক্ষমতার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। গণমানুষের স্বার্থে ডিএসএ ভিক্টিমস নেটওয়ার্কের এই সকল দাবি মানা না হলে অবিলম্বে সারা দেশে এই আইনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে নিয়ে বৃহত্তর কর্মসূচির ডাক দেয়া হবে বলেও ঘোষণা দেয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার ভুক্তভোগীরা তাদের ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন। এই মামলায় বর্তমানে কারাগারে আটক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরার বোন সিরাজুম মুনিরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বোনের মামলার ব্যাপারে আমরা কেউ জানতাম না। আমার বোন অসুস্থ। এতদিন ধরে আমার বোনকে আটকে রেখেছে। খাজিদাসহ অন্যান্যদের মুক্তি চাই। সেইসঙ্গে এই আইনটি বাতিল চাই।
ইশরাত জাহান নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, ২০২০ সালের নভেম্বরে র্যাব আমাকে বাসা থেকে আটক করে। এরপর রিমান্ডে ও কারাগারে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ২ বছর ৭ মাস কারাবাস করেছি। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের এন ইউ আহমেদ দাবি করেন, তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সহযোগিতা চাইতে গিয়ে উল্টো নিজেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনি ১১ মাস কারাগারে ছিলেন। দীর্ঘ ৫ বছর ধরে মামলার ঘানি টানছেন। ভুক্তভোগী সোনিয়া আক্তার স্মৃতি বলেন, এই মামলায় আমি চার মাস জেল খেটেছি। এই কালো আইন বাতিল চাই। এটা খুবই অমানবিক। এ সময় ভুক্তভোগী আরও অনেকে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন।