আ.লীগে ঐক্য ফেরানোর সভাতেও অনৈক্য-হট্টগোল
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের থানা-ওয়ার্ড কমিটি না হওয়া, দলের অভ্যন্তরে সমন্বয়হীনতা, ত্যাগী কর্মীদের অবমূল্যায়ন ও কোটা আন্দোলনে অনেক পদধারী শীর্ষ নেতা, সংসদ-সদস্য এবং দলের সুবিধাভোগীরা মাঠে না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: কোটা আন্দোলন ঘিরে ঘটা সহিংসতা প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামতে পারেনি আওয়ামী লীগ। এরপর থেকে দলে ঐক্য ফেরাতে থানা-ওয়ার্ড নেতাকর্মী ও দলীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সমন্বয় সভা করছে দলটি। তবে এই সমন্বয় সভাতেও দেখা গেল বিশৃঙ্খলা ও হট্টগোল। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের থানা-ওয়ার্ড কমিটি না হওয়া, দলের অভ্যন্তরে সমন্বয়হীনতা, ত্যাগী কর্মীদের অবমূল্যায়ন ও কোটা আন্দোলনে অনেক পদধারী শীর্ষ নেতা, সংসদ-সদস্য এবং দলের সুবিধাভোগীরা মাঠে না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দলের তৃতীয় দিনের মতো সমন্বয় সভা ডাকা হয়। ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসাবে এদিনও কেন্দ্রীয় ও নগরের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও ঢাকা-১১, ঢাকা-১৪, ঢাকা-১৫, ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ-সদস্য এবং থানা-ওয়ার্ড নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সভার শুরুতে সূচনা বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবাদুল কাদের। পরে শুরু হয় রুদ্ধদ্বার আলোচনা। এ সময় থানা ও ওয়ার্ড নেতারা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ড থেকে একজন করে নেতার বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল।
সভার শুরুতে কথা বলেন উত্তরের একটি ওয়ার্ডের সভাপতি আমির উদ্দিন। তিনি তার বক্তব্যে মিরপুর-১০ এলাকায় স্থানীয় সংসদ-সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের নির্দেশনায় মাঠে থাকার দাবি করেন। তার এমন বক্তব্যের পরপরই উপস্থিত নেতাকর্মীরা হট্টগোল শুরু করেন।
তারা দাবি করেন, কামাল আহমেদ মজুমদার ও তার অনুসারীরা কেউ ওই এলাকায় ছিলেন না। এ সময় মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বারবার চেষ্টা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হন। পরে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
এরপর বক্তব্য শুরু করেন কাফরুল থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি জামাল মোস্তফা। তিনি বলেন, আজকে দলের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী সমন্বয়হীনতা। দলের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই। এ সমস্যার মূলে রয়েছে থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি না থাকা। কমিটি থাকলে এমন সমস্যায় পড়তে হতো না।
ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনি দলের সাধারণ সম্পাদক। আপনি নগরের থানা-ওয়ার্ড কমিটি দেন। কমিটি থাকলে এমন পরিস্থিতি হবে না। এ সময় উত্তর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি তাকে থামিয়ে দেন। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? সবাই সে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবেন। এখানে কমিটি গঠন নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবেন না।
পল্লবী থানার ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আশিকুল ইসলাম আশিক বলেন, আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু বাস্তবে আমাদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। একজন আরেকজন নেতার কথা শোনেন না। তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশ করে বলেন, দলের সবাই যেন সবার কথা শোনেন। সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে দল ঘুরে দাঁড়াবে। ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজউদ্দিন বাপ্পি তার বক্তব্যে আন্দোলনে যুক্ত বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের চিহ্নিত করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা জানান।
নিজ এলাকায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী মাঠে ছিলেন দাবি করেন পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার এমন বক্তব্যের জবাবে উপস্থিত নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান। কেউ কেউ বলতে থাকেন আপনি নিজেই মাঠে ছিলেন না। এ সময় তাকে উদ্দেশ করে ভুয়া ভুয়া স্লোগান দিতে শোনা যায়।
এ পর্যায়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাইক্রোফোন হাতে নেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। তিনি সবাইকে চুপ থাকার অনুরোধ করে বলেন, দলের কোথায় সমস্যা আমরা বুঝেছি। এই পরিবেশে আর কারও বক্তব্য আমরা শুনব না। প্রয়োজনে প্রতিটি থানা-ওয়ার্ড নিয়ে পৃথক ভাবে বসা হবে। এরপর আর কাউকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
পরে সভা সমাপ্ত ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, আপনারা কারা মাঠে ছিলেন? আর কারা মাঠে ছিলেন না? আমাদের কাছে সব তথ্য আছে। আপনারা দলের পদে থেকে ঘরে বসে থাকবেন? দলের খারাপ সময়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন? তা হতে পারে না। যারা মাঠে ছিলেন না তাদের তালিকা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তালিকা ধরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভেঙে দেওয়া হলো আ.লীগের ২৬ ইউনিট কমিটি : এদিকে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটা সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে না থাকার অভিযোগে ভেঙে দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অন্তর্গত ২৬টি ইউনিট কমিটি। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ঢাকা-১৩ সংসদীয় আসনের অন্তর্গত ৮টি ওয়ার্ডের ১২৬ ইউনিট কমিটির মধ্যে ২৬টি কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় মোহাম্মদুপরের সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অন্তর্গত ঢাকা-১৩ আসনের তিন থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের নিয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ঢাকা-১৩ আসনের সংসদ-সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ ফজলুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক রানা, স্থানীয় কাউন্সিলর, থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, সভায় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অন্তর্গত মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানার ২৭টি ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা আন্দোলন মোকাবিলায় সরাসরি অংশ নেননি বলে অভিযোগ ওঠে। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসব ইউনিটের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।