অভাবে পেশা বদল, তবুও কাটছে না শঙ্কা
করোনাকালে ধকল গেছে দুই বছর। বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মাসের পর মাস ঘরবন্দি জীবদ্দশায় আর্থিক সংকটে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল দেয়ালে। হাঁসফাঁস করতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। তাদেরই একজন উদ্যোক্তা সোহরাব হোসেন।
প্রথম নিউজ, রংপুর: করোনাকালে ধকল গেছে দুই বছর। বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মাসের পর মাস ঘরবন্দি জীবদ্দশায় আর্থিক সংকটে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল দেয়ালে। হাঁসফাঁস করতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। তাদেরই একজন উদ্যোক্তা সোহরাব হোসেন। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গ্রামে গড়েছিলেন একটি স্কুল। কিন্তু করোনায় তার স্বপ্ন ভেঙে যায়। ঋণের বোঝা আর সংসারের চাপে বাধ্য হয়ে কষ্টে গড়া কিন্ডারগার্টেন স্কুলটি বিক্রি করে দেন। এরপরও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি সোহরাব।
৮ বছর আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করা সোহরাব হোসেন এখন নামে ব্যবসায়ী। বাড়ির পাশে ছোট্ট একটি মুদি দোকানই তার জীবিকার ভরসা। এর আগে স্কুল বিক্রি করে অটোরিকশা চালিয়েছেন তিনি। প্রতিদিন অটোরিকশা চালিয়ে যা আয় হতো, তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার চললেও বাড়িভাড়া আর গ্রামে থাকা মা-বাবাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল তার। তাই উপায় না পেয়ে দ্বিতীয় দফায় পেশা বদল করে সংসারের হাল সামলাতে হচ্ছে তাকে। তবে এখনো যে তিনি ভালো আছেন, সেটা মানতে নারাজ।
নিজের সংসার, সন্তান, মা-বাবা আর বাড়িভাড়ার হিসেব কষে প্রতিদিন অজানা আতঙ্কে আঁতকে উঠছেন সোহরাব হোসেনের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষজন। সোহরাব হোসেন বলেন, মহামারি কারোনাকালে কে কতটা অসহায় ছিল, তা এখনো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তখন ঘরে-বাইরে থাকা মানুষদের কেউ জীবন বাঁচার জন্য ঘরবন্দি ছিল। আর কেউবা জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য ঘরের বাইরে ছিল। ঘরে-বাইরে সবখানে বাঁচার যুদ্ধ চলেছে। এখনো সেই যুদ্ধ শেষ হয়নি। বরং দিন দিন কর্মহীন মানুষেরা অজানা শঙ্কায় পেশা পাল্টাচ্ছেন।
সোহরাব হোসেন রংপুর মহানগরীর আরাজি এলাকায় থাকেন। তবে তার প্রতিষ্ঠিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলটি কোথায় ছিল, আর গ্রামের বাড়িই বা কোথায়- তা না জানালেও কথা বলার সময় তার চোখের টলমলে জলই বলে দিয়েছে তিনি কতটা অসহায়। বর্তমানে ব্যবসায়ে মন্দাভাব আর নতুন করে বিশ্ব অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টির আগাম আভাসে চিন্তিত তিনি।
মানুষের সামাজিক অবনমনের এই চিত্র এক সময়ে মঙ্গাপীড়িত উত্তরের জেলা রংপুরের হলেও বাস্তবে এখন তা পুরো দেশের। সম্প্রতি রংপুর মহানগরীর জাহাজ কোম্পানি মোড় থেকে শাপলা চত্বরে আসার সময় এক বয়স্ক চালকের অটোরিকশা চালানোর গতিবিধি দেখে কৌতূহল জাগে। চাচা আপনি কি নতুন? এই একটা প্রশ্ন থেকেই জানা যায় অনেক কথা।
অটোরিকশাচালক জহুরুল হকের বাড়ি কুড়িগ্রামে। নদীভাঙন আর অভাব-অনটনে জমানো পুঁজি শেষ হওয়ায় বয়স্ক মানুষটি এখন রংপুরে এসে রিকশা টানছেন। দুই মেয়ের বিয়ে দেওয়া জহুরুলের সংসারের হাল ধরার মতো কেউ নেই। তার তাই আক্ষেপও অনেক বেশি। তার মতো আরও অসংখ্য মানুষ এখন জীবিকার তাগিদে গ্রাম থেকে শহরে আসছেন। পুরোনো পেশা বদল করে নতুন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।
জহুরুল হকের ভাষ্য মতে, সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা কোনোভাবেই নিজেদের সামলাতে পারছেন না। বাধ্য হয়েই কেউ হয়েছেন ফেরিওয়ালা, কেউবা সবজি বিক্রেতা নয়তো অটোরিকশাচালক। এখন শুধু বয়স্ক ব্যক্তিরা নয়, তরুণরাও উপায় না পেয়ে রাস্তায় ফেরি করে ফল, কাপড়, কফিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করছে। অথচ তাদের অনেকই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার যোগ্যতা রাখে।
গত বছর ঢাকায় চাকরি হারিয়ে রংপুরে এসেছেন এক যুবক। পড়ালেখার পাশাপাশি ছোট একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করতেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি করোনায় মুখ থুবড়ে পড়ার ধকল সইতে না পেরে অনেক কর্মীকে ছাঁটাই করে। সেই তালিকায় দুই মাসের বকেয়া বেতন না পেয়ে শূন্য হাতে গ্রামে ফিরে এসেছেন সুমন ইসলাম। এখন তিনি রংপুর মহানগরীর পায়রা চত্বরে ফুটপাতের ওপর ছোট্ট একটা অস্থায়ী টেবিল বসিয়ে টি-শার্ট ও প্যান্ট বিক্রি করছেন। শুধু সুমনই নয় এমন অসংখ্য তরুণ, যুবক এখন ফুটপাতের ওপর ভাসমান ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েছেন।
রংপুর মহানগরীর মডার্ন মোড়, শাপলা চত্বর, লালবাগ, জাহাজ কোম্পানি মোড়, পায়রা চত্বর, সিটি বাজার, কাচারি বাজার, ধাপ, মেডিকেল মোড়, বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো ঘুরলে সুমন, জহুরুল, সোহরাবের মতো সামাজিক অবনমনের শিকার হওয়া অসংখ্য মানুষের দেখা মিলবে।
নগরীর শাপলা চত্বরে সান্ধ্যকালীন কাঁচা বাজারে কথা হয় সবজি বিক্রেতা আনারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি আগে একটি শো-রুমে চাকরি করতেন। কিন্তু পরিশ্রমের তুলনায় বেতন কম হওয়াতে চাকরি ছেড়েছেন। এ যুবকের সংসারে তিনি ছাড়া উপার্জনক্ষম আর কেউ নেই। গ্রাম ছেড়ে শহরে থাকায় বেড়েছে টানাপোড়েন। সংসার সামলাতে দিশেহারা আনারুল এখন ভ্যানে করে শাকসবজি বিক্রি করেন। যা আয় হচ্ছে তাই দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলছে। তবে আগামী দিনগুলোতে কী হবে আর কীভাবে চলবেন, তা নিয়ে চিন্তিত তিনি।
পায়রা চত্বরে কথা হয় একজন ভ্রাম্যমাণ পান বিক্রেতার সঙ্গে। দাড়িভর্তি মুখ আর পাকা চুলে তার বয়সের ছাপ স্পষ্ট। ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি নিজের নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, তার বাড়ি কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌর এলাকায়। গ্রামে দিনমজুর হিসেবে প্রতিদিন যা আয় হয়, তা দিয়ে ছয় সন্তানের সংসার চালানো কষ্টকর। এ কারণে সন্ধ্যার পর কয়েক ঘণ্টার জন্য শহরে এসে পান-বিড়ি বিক্রি করেন তিনি। এতে তার প্রতিদিন বাড়তি ২০০-৩০০ টাকা আয় হচ্ছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর বেসামাল দাম আর প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে শোনা ২০২৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষের আগাম সতর্কবার্তায় ভীষণ চিন্তিত এই দিনমজুর।
রংপুর মহানগরসহ জেলায় এমন পরিবারের সংখ্যা কতটি বা কতজন মানুষ পেশা বদল করে জীবিকার তাগিদে নতুন পেশায় ঝুঁকেছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে করোনার প্রকোপ, বৈশ্বিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সংকট, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘ হলে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সুশীল সমাজ ও সচেতন নাগরিকরা।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, দিনমজুর, শ্রমিকসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের চাকরিজীবীরা করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বর্তমানে পত্রিকার হকার, রংমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বিভিন্ন দোকান-প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা বেশি ঝুঁকিতে আছেন। এসব মানুষের জন্য সরকারি-বেসরকারি সহায়তা থাকলেও তা পর্যাপ্ত না হওয়ায় জীবিকার তাগিদে অনেকেই বাধ্য হয়ে পেশা বদল করেছেন। আবার পেশা বদল করেও অনেকের মুখে হাসি নেই। বরং নতুন পেশায় কারও কারও জীবিকা উপার্জন যেমন চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি নিত্যনতুন সংকট তাদের পোড়াচ্ছে।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, সরকার যেকোনো দুর্যোগ ও সংকটময় মুহূর্তে জনগণের পাশে ছিল। সেই ধারাবাহিকতা থেকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন সময় রংপুর সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থার মাধ্যমে মহানগরসহ আট উপজেলাতে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এখনো কোথাও কোনো বড় ধরনের দুর্যোগ, দুর্ঘটনা দেখা দিলে আমরা চেষ্টা করছি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু মানুষের পেশার সামাজিক অবনমন, অবনয়ন, পতন, অবনতি ও ক্ষয় হচ্ছে তা শুধু রংপুরে নয়, এটা সারা দেশের চিত্র।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও উন্নয়ন গবেষক উমর ফারুক বলেন, মানুষের সামাজিক অবস্থানে অবনমন ঘটেছে। হয়তো কেউ চাকরি করে মর্যাদা নিয়ে সমাজে বসবাস করতেন। আজ তিনি চাকরি হারিয়ে, ইনকামের পথ না পেয়ে রাস্তায় নেমেছেন। ছোট কোনো চাকরির সঙ্গে নিজেকে জড়াচ্ছেন। এটাকে দুর্যোগ মুহূর্তে সামাজিক অবনমন বলে। বাঁচার জন্য মানুষ বিকল্প জীবিকার পথ খুঁজবেন এটাই স্বাভাবিক, এটা বাস্তবতা। এই ধরনের সামাজিক অবনমন ঠেকাতে হলে সরকার দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের জন্য যেসব ব্যবস্থা নিয়েছেন উপযুক্তভাবে এসব পরিপালন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা তো বৈশ্বিক একটা সংকটের মধ্যে সময় পার করছি। এর প্রভাব সবক্ষেত্রে পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এই সংকট মোকাবিলায় চেষ্টা করছে। কিন্তু জাতিসংঘসহ দাতা দেশগুলো ২০২৩ সালের দিকে যে দুর্ভিক্ষ বা বিশ্বমন্দার কথা বলছেন, সেটিও আমাদের মতো দেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী বারবার খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে কৃষি জমির এক ইঞ্চিও ফেলে না রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews