৬ তলা ভবন পড়ে আছে ৪ বছর, রোগীরা মেঝেতে

বরাদ্দ না থাকায় থমকে আছে সিসিইউ ও আইসিইউ ভবনের কাজও। হাসপাতালটিতে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি।

৬ তলা ভবন পড়ে আছে ৪ বছর, রোগীরা মেঝেতে

প্রথম নিউজ, নীলফামারী: নীলফামারী জেলার প্রায় ২২ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবার একমাত্র ভরসাস্থল ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। সেই হাসপাতালের একটি ভবনের চতুর্থ তলা থেকে ৬ষ্ঠ তলা পর্যন্ত পড়ে আছে প্রায় চার বছর ধরে। অথচ শয্যাসংকটের কারণে পুরোনো ভবনের ওয়ার্ড ও বারান্দার মেঝেতেই দিনের পর দিন চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন রোগীরা।

বরাদ্দ না থাকায় থমকে আছে সিসিইউ ও আইসিইউ ভবনের কাজও। হাসপাতালটিতে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। এছাড়া ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা এই হাসপাতালে প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ বাড়ায় সংকট দেখা দিয়েছে ওষুধ ও খাবারেও। আবার রোগীর তুলনায় পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে।

১০০ শয্যার হাসপাতালটি ২০১১ সালে ২৫০ শয্যায় উন্নীতের ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ২৫ জুলাই ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৫০ শয্যার সম্প্রসারিত ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। আটতলা ভিত্তির ভবনটির ছয়তলার নির্মাণকাজে সময় লাগে প্রায় ছয় বছর। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ভবনটি হস্তান্তর করে গণপূর্ত বিভাগ। এরপর ২৫০ শয্যার জন্য জনবল ও অর্থ বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানায় স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে তাতে কাজ না হওয়ায় পুরোনো ভবনে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ২৭৩। কিন্তু হাসপাতালটিতে ৫৬ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ২৯ জন। ১৫১ জন নার্সিং স্টাফের বিপরীতে রয়েছেন ১৪৫ জন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর ২৮ পদের বিপরীতে রয়েছেন ১২ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির ২৭ পদে রয়েছেন ২০ জন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নতুন ভবনে কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় হাসপাতালের পুরোনো ভবনে শয্যা বাড়িয়ে ১৭০টি করা হয়েছে। এদিকে হাসপাতালের কয়েক দিনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই ওয়ার্ডগুলোতে নির্ধারিত শয্যার অতিরিক্ত রোগী থাকছেন। শয্যার অভাবে হাসপাতালের মেঝেতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রোববার (২‌১ মে) দুপুরে হাসপাতালের ৪২ শয্যার মহিলা ওয়ার্ডে ৬৯ জন রোগী ভর্তি পাওয়া যায়। একইভাবে ২৫ শয্যার পুরুষ ওয়ার্ডে ৫০ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। শনিবার (২০ মে) ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে ৩২৮ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে শিশু ওয়ার্ডে ৪৫ জন, পুরুষ ওয়ার্ডে ৫৯ জন, মহিলা ওয়ার্ডে ৬১ জন, নবজাতক ওয়ার্ডে ২৭ জন, প্রসূতি ওয়ার্ডে ৪৫ জন ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ২৩ জন ছিলেন। গত শুক্রবার এখানে ৩০৪ জন ও আগের দিন বৃহস্পতিবার ৩০৭ জন রোগী ভর্তি ছিলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন নার্স ঢাকা পোস্টকে জানান, ওয়ার্ডগুলোতে প্রতিদিনই ধারণক্ষমতার বেশি রোগী থাকছেন। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে ওয়ার্ডগুলোতে অতিরিক্ত বিছানা ঢোকানো হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, সকালে জ্বর, বুকে ও পিঠে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছি। ভেতরে জায়গা নেই দেখে বাইরে বেড করে দিছে, তাই এখানেই আছি। ডাক্তার এখনো দেখে নাই।

মহিলা ওয়ার্ডের মেঝেতে থেকেই চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন অমিছা বেগম। তিনি বলেন, বাড়িতে জমি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে মারামারিতে মাথা ফেঁটে গেছে। কালকে হাসপাতালে ভর্তি হইছি। এখনো ডাক্তার দেখে নাই। আমার মাথায় পাঁচটা সেলাই, আমার বাবার বাবার মাথায় তিনটা। এখানে আমরা পড়ে আছি চিকিৎসা তেমন পাচ্ছি না। ওষুধপত্র আমাদের বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।

লক্ষ্মী চাপ এলাকার শহিদুল আলম বলেন, আমরা গরিব মানুষ,  চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে আসছি কিন্তু চিকিৎসা আমি ঠিকমতো পাচ্ছি না। যা ওষুধ ওরা লিখছে সব বাহির থেকে কিনে আনি খাইতেছি। আমি গরিব মানুষ, এত টাকা কই পাবো যে বাহির থেকে ওষুধ কিনবো। আমি তো এমনি চলতে পারি না।

কচুকাটা এলাকার দুলাল হোসেন বলেন, মানুষের কাছত (কাছে) শুনছি নীলফামারী হাসপাতাল বিশাল কিন্তু আসি দেখেছি একটা বেডে চারটা রোগী। সময়তো ডাক্তার বাবু খুঁজি পাওয়া যায় না। আমার সরকারের কাছে দাবি, বেড আরও বাড়ানো হোক, কেবিন বাড়ানো হোক। একটা করে রোগী একটা করে বেডে থাকবে। মেঝেতে চিকিৎসা নেওয়া কুলসুম আক্তার  বলেন, চারদিন ধরি সর্দি জ্বর। এই যে নিচে শুতির লাগে, বেড নাই বেড হলে ভালো হয়। অনেকজনে নিচে পড়ে আছি। আর এভাবে থাকলে শরীর ভালো হওয়ার থেকে খারাপ হবে বেশি।

হাসপাতালটির আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. গোলাম রসুল রাখি  বলেন, হাসপাতালটি আগে ১০০ শয্যার হাসপাতাল ছিল, পরবর্তীতে এটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। আমাদের নতুন বিল্ডিংয়ে শয্যা স্থাপন করতে পারিনি। পুরাতন বিল্ডিংয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। আর নতুন বিল্ডিংয়ের তিন তলা পর্যন্ত চালু করেছি। আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ জন রোগী ভর্তি থাকতেছে। আমাদের হাসপাতালে লোকবলের সংকট রয়েছে। মঞ্জুরি পদের তুলনায় চিকিৎসক ৫০ শতাংশ রয়েছে। যা দিয়ে আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আবু-আল-হাজ্জাজ বলেন, আমাদের হাসপাতালটার ২৫০ শয্যার কার্যক্রম ২০২০ সালে চালু হয়। এখানে আগে ১০০ শয্যার কার্যক্রম চলছিল, সেখান থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত ১৫০ শয্যা স্থাপন করা যায় নাই। আমাদের নতুন বিল্ডিংয়ে ১০০ শয্যা চালু করা যাবে। নতুন বিল্ডিংটি আটতলা পর্যন্ত আমাদের প্লানে ছিল তবে, ছয়তলা পর্যন্ত বরাদ্দ আসে। ২০১৯ সালে ছয় তলার কাজ শেষ হয়ে যায় এবং হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু সাত তলার বরাদ্দ পরবর্তীতে আবার আসে এবং সাত তলার কার্যক্রম চলতেছে। যে ঠিকাদার এই কাজটা পেয়েছে গণপূর্ত বিভাগ থেকে তার ভাষ্যমতে এখন পর্যন্ত কোনো বিল পায়নি। আর বিল না পাওয়ার কারণে ওই বিল্ডিংয়ের অসমাপ্ত কাজ শেষ করা যায়নি।

তিনি আরও বলেন, নতুন ভবনে তিন তলা পর্যন্ত আমাদের সেবা চালু করেছি। আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব চালু করেছি। পরবর্তীতে আসবাবপত্রের বরাদ্দ ও লিফট চালু হলে ভবনের ৪র্থ থেকে ৬ষ্ট তলায় কার্যক্রম শুরু করতে পারবো। সেটার জন্য আমরা উর্ধ্বতনকে জানিয়েছি এবং অপেক্ষা করছি।