২১০ টন গুঁড়াদুধ বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি কাস্টমসের, মান নিয়ে প্রশ্ন

 আমদানি হয় দেড় বছর আগে, দীর্ঘদিন পড়ে আছে কনটেইনারে, খাদ্যগুণ নষ্ট হওয়ার শঙ্কা, চটকদার মোড়কে ভোক্তারা প্রতারিত হওয়ার শঙ্কা

২১০ টন গুঁড়াদুধ বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি কাস্টমসের, মান নিয়ে প্রশ্ন

প্রথম নিউজ,, চট্টগ্রাম: দেড় বছর আগে আমদানি হওয়া ২১০ টন গুঁড়াদুধ নিলামের মাধ্যমে বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। ২১০ টনের মধ্যে সোমবার (১৩ নভেম্বর) উন্মুক্ত নিলামে তোলা হবে ১১০ টন। এর আগে গত ৬ নভেম্বর নিলাম হয়েছে ১০০ টন দুধের। দেশে খাদ্য নিরাপদ করার কাজে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, দীর্ঘদিন কনটেইনারে পড়ে থাকায় এসব খাদ্যপণ্য ‘অনিরাপদ’ হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে কাস্টম বলছে, বাজারে ছাড়ার আগে মান পরীক্ষা করেই ছাড়া হবে। তবে বন্দর থেকে রিমুভাল লিস্ট পাওয়ার ১৬ মাস পর এসব খাদ্যপণ্য নিলামে তোলায় দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, শত টাকার কমে কেজিতে এসব গুঁড়াদুধ নিলামে কিনে চটকদার মোড়কে বাজারে ছেড়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে পারে সংঘবদ্ধ চক্র। এতে ভোক্তারা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তেমনি অনিরাপদ এসব গুঁড়াদুধ খেয়ে পড়তে পারেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও।

চট্টগ্রাম কাস্টম সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের কাচপুর এলাকার অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালের শুরুতে ভারত থেকে দুই চালানে ২১০ টন স্কিমড মিল্ক পাউডার আমদানি করে। চালান দুটি নির্ধারিত সময়ে খালাস নেয়নি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীসময়ে ২০২২ সালের ৪ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টমকে রিমুভাল লিস্ট (অখালাসকৃত কনটেইনারের তালিকা) দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। দুদিন পর ৬ জুলাই চালান দুটির ইনভেন্ট্রি সম্পন্ন করে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। চালান দুটিতে চারটি করে মোট ৮ কনটেইনারে এসব গুঁড়াদুধ রয়েছে।

কাস্টম কর্তৃপক্ষ প্রথম চালানে ১০০ টন গুঁড়াদুধের দাম নির্ধারণ করে ২ কোটি ৮৯ লাখ ২৫ হাজার ৮৯৬ টাকা ৬০ পয়সা। এতে প্রতি কেজি দুধের মূল্য ধরা হয় ২৮৯ টাকা ২৫ পয়সা। গত ৬ নভেম্বর প্রকাশ্য নিলামে তোলা হয় চালানটি। ওই চালানটি নিলামে ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা দর দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা হন চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রাবাদ ছোটপুল এলাকার মেসার্স মাসুম এন্টারপ্রাইজ। নিলামে প্রতি কেজি গুঁড়াদুধের দাম পড়ে ৫৮ টাকা ৯৫ পয়সা। তবে চালানটি এখনো খালাস দেওয়া হয়নি।

এরপর দ্বিতীয় চালানে অবশিষ্ট ১১০ টন গুঁড়াদুধ প্রকাশ্য নিলামে তোলার উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম কাস্টম। কাস্টম কর্তৃপক্ষ চালানের ১১০ টন গুঁড়াদুধের দাম নির্ধারণ করে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯৬৩ টাকা ১৪ পয়সা। এতে প্রতি কেজি গুঁড়াদুধের সংরক্ষিত দাম নির্ধারণ করা হয় ৩০৩ টাকা ৪৩ পয়সা। সোমবার প্রকাশ্য এই নিলাম অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে কাস্টম। কাস্টমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত এসব দুধের মেয়াদ রয়েছে।

বর্তমানে গুঁড়াদুধ ভর্তি কনটেইনারগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে বন্দরে কনটেইনারে পড়ে থাকা এসব খাদ্যপণ্যের খাদ্যগুণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারহান ইসলাম  বলেন, কোনো পণ্য দীর্ঘদিন ধরে কনটেইনারে পড়ে থাকলে তার খাদ্যগুণ নষ্ট হতে পারে। কারণ গুঁড়াদুধ একটি প্রক্রিয়াজাত খাবার। এটি নির্ধারিত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। যদি দীর্ঘদিন নির্ধারিত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা না যায়, তার খাদ্যগুণ নষ্ট হয়ে যাবে। এতে মেয়াদ থাকলেও খাদ্যগুণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

তিনি বলেন, দেশীয় কিংবা আমদানি করা সব ধরনের খাদ্যপণ্য তদারকি করার এখতিয়ার নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের রয়েছে। আমরা এর আগেও আমদানি করা যে কোনো খাদ্যপণ্য খালাসের আগে আমাদের অবগত করার বিষয়ে কাস্টম কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলাম। এতে আমরা আমদানি করা খাদ্যপণ্য নিরাপদ কি না, তা তদারকি করতে পারবো। এক্ষেত্রেও নিলামে তোলা গুঁড়াদুধগুলো খাবার উপযোগী কি না, তাও যাচাই করা সম্ভব হবে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন  বলেন, একটি পণ্য আমদানি করার পর আমদানিকারক নির্ধারিত সময়ে খালাস না নিলে তা নিলামে তোলার এখতিয়ার কাস্টমের রয়েছে। কিন্তু গুঁড়াদুধের মতো খাদ্যপণ্য দেড় বছর আগে আমদানি হলেও নিলামে তুলতে এত দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন কনটেইনারবন্দি অবস্থায় পড়ে থাকায় এসব দুধের খাদ্যগুণ সঠিক থাকার কথা নয়। নিলামে তোলার আগে এসব গুঁড়াদুধ খাবার উপযোগী কি না, তা আগে যাচাই করা জরুরি। নচেৎ এসব দুধ বাজারে গেলে ভোক্তারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারেন।

তিনি বলেন, এখন দেশীয় বাজারে গুঁড়াদুধের কেজি ৮০০ টাকার ওপরে। নিলামে একশ টাকার কমে কিনে সংঘবদ্ধ চক্র ঝকঝকে মোড়কভর্তি করে বাজারে ছেড়ে একশ টাকার দুধ ৮০০ টাকায় বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে পারে। কারণ যখন বাজারে যাবে তখন এসব দুধের বিপণন তদারকি করার সুযোগ সরকারি কর্তৃপক্ষের নেই। যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে ভোক্তারা একদিকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, অন্যদিকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও পড়বেন।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম কাস্টমের নিলাম শাখার দায়িত্বে থাকা উপ-কমিশনার মো. আবদুল হান্নান বলেন, বন্দরে আসার পর ৩০ দিনের মধ্যে খালাস হয় না, এমন পণ্যের তালিকা (রিমুভাল লিস্ট) বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের (কাস্টম) দেয়। চালান দুটি দুবার নিয়মিত নিলামে তোলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো বিডার নিলামে অংশ নেননি। এতে এসব গুঁড়াদুধ পচনশীল বিবেচনায় প্রকাশ্য নিলামে তোলা হচ্ছে। প্রকাশ্য নিলামে আগ্রহী ক্রেতা খুঁজতে মাইকিংও করা হয়েছে। গত ৬ নভেম্বর নিলাম হওয়া ১০০ টন গুঁড়াদুধের প্রথম চালানটির খালাস প্রক্রিয়াধীন বলে জানান তিনি।

এসব গুঁড়াদুধের খাদ্যগুণ ঠিক আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নিয়ম অনুযায়ী প্রকাশ্য নিলামে তুলেছি। তবে যিনিই সর্বোচ্চ দরদাতা হোক না কেন, খালাস নেওয়ার আগে এসব দুধ খাবার উপযোগী কি না তা পরীক্ষা করেই খালাস দেওয়া হবে।