প্রথম নিউজ, অনলাইন: চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের নৈতিক এবং রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে বলে মনে করে এ আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থান বলে আখ্যা দিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন। বৃহস্পতিবার (১ আগষ্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বক্তারা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসণের দাবিতে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে নাগরিক সংগঠন সুজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন," এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের নৈতিক এবং রাজনৈতিক পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে। ২০২৪ সালে যেটি হয়েছে সেটা একটি গণঅভ্যুত্থান। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে মাত্র ৬১ জন মানুষ মারা গেছে। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান থেকে চারগুণ বেশি মানুষ মারা গেছে। গণঅভ্যুত্থানের চরিত্র কাকে বলে? যেখানে সমস্ত শ্রেণী পেশার মানুষ থাকে। এখানে শিশু, নারী, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষরা এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। "
৫২ এর ভাষা আন্দোলনে ১২ জন মারা গিয়েছেন জানিয়ে এই অধ্যাপক বলেন," আমরা এই আন্দোলনকে সাংস্কৃতিক না একটি রাজনৈতিক আন্দোলন বলি। মানুষের যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিল ৪৭থেকে ৫২ পর্যন্ত সব ধরণের মানুষ সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করেছে। ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেছে। তার রেশ এখনো চলছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের নৈতিক এবং রাজনৈতিক পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে।"
তিনি বলেন," আপনি আপনার রাষ্ট্রের নিজস্ব নাগরিক মারার জন্য হেলিকাপ্টারের ব্যবহার করেছেন। সেখান থেকে টিয়ারশেল, সাউন্ডগ্রেন্ড নিক্ষেপ ও গুলি ও ছোড়া হয়েছে। ঘরের মধ্যে শিশুকে মারা হয়েছে। সাংবাদিককে মারা হয়েছে। এটা যদি গণঅভ্যুত্থান না হয় তাহলে গণঅভ্যুত্থান কোনটা আমি ঠিক জানি না। "
আওয়ামী লীগ চলে গেলে কি বিএনপি জামায়েত আসবে এমন প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন," আমরা বিএনপিকে দেখেছি ব্যর্থ হয়েছে। জামায়েতকে দেখেছি; জাতীয় পার্টিকে দেখেছি ব্যর্থ হয়েছে। সমস্ত রাজনৈতিক দল যারা ব্যর্থ হয়েছে তাদের সবাইকে না বলতে হবে।
"দেশের সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক। তিনি বলেন," তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা আমাদের দেখাচ্ছে কিভাবে নতুন সংবিধান লিখতে হয়। নতুন রাজনৈতিক দল তৈরী করতে হবে। "
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে এত অল্প সময়ে এত মানুষের মৃত্যু হয় নাই জানিয়ে তিনি বলেন," ছাত্রদের রক্ত এরশাদের হাতে। আওয়ামী লীগের মতন ৭৫ বয়সী একটা দলের হাতে ছাত্রদের রক্ত। পৃথিবীর ইতিহাস বলে শিক্ষার্থীদের কোনো রক্ত কোনো আন্দোলন কোনো দিন ব্যর্থ হতে পারে না। আমি মনে করি এই আন্দোলন ব্যর্থ হতে পারে না। "
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সমালোচনা করেন রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, তার দলের লোকজন ডেকে মতবিনিময়ের নামে তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। আপনি আপনার নিজ দলের নেতাদের সঙ্গে অসৎ। তাহলে আপনি বিরোধীদল ছাত্রদের সঙ্গে সংলাপে সৎ থাকবেন।"
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন,"ছাত্র সমাজ যে দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে, আমরা সুজনের পক্ষ থেকে একাত্মতা পোষণ করছি। ছাত্র সমাজ তাদের সরকারি চাকরির অধিকার থেকে বঞ্চিত। ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ততা না থাকলে সরকারি, আধা সরকারি থেকে শুরু করে কোনো চাকরি পাওয়া যায়না। "
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বলে মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, অনেকগুলো মৌলিক অধিকার থেকে ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে আমরা সবাই বঞ্চিত। ভোটাধিকার থেকে আমরা সবাই বঞ্চিত। মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। নাগরিক হিসেবে যেগুলো আমাদের সংবিধান স্বীকৃত সেগুলো থেকে আমরা বঞ্চিত। "
ভোটাধিকার না থাকার কারণে সরকারের কোনো জবাবদিহিতা নেই বলে দাবি করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন,"এজন্য তারা বল প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করছে। "
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি ও পরিবেশ সংগঠন বেলা প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, "সরকারের পক্ষ থেকে সংকট নিরসনে কোনো কার্যকর ভুমিকা আমরা দেখছি না। সরকার কোনোরকমভাবে একটা প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা করছে। আজকে যে ক্ষতটা এই জাতির হৃদয়ে হয়ে গেছে সেটা অনেক বেশি গভীর।"
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলো হলো এটা গোটা জাতিকে প্রভাবিত করেছে বলে মনে করেন রিজওয়ানা। তিনি বলেন,"আমরা কেউই এখন আর মানসিকভাবে ভালো থাকতে পারছি না। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলো হয়েছে এটি ক্ষমা করার কোনো সুযোগ নেই। এতগুলো মানুষের প্রাণ নিয়ে নেওয়া হয়েছে, এটাকে আমরা কিভাবে ক্ষমা করবো!"
এবার যদি বাংলাদেশে বিচার না হয় তাহলে দেশ থেকে বিচার শব্দটা একেবারেই উঠে যাবে বলে মনে করেন এই আইনজীবি। তিনি বলেন,"এবার নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিচারের দাবি জানাতে হবে। বিচার না হওয়া পর্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মহলে সংশ্লিষ্ট নিশ্চিত করে বিচার না হওয়া অব্দি আমাদের চুপ হয়ে যাওয়া অথবা সান্ত্বনা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। "
অচলাবস্থা নিরসণে সরকারের প্রতি সুজনের সুপারিশ-
১. নিহতদের নাম পরিচয়সহ বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত তালিকা প্রকাশ করা
২. নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সহিংসতার সব ঘটনার স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করা এবং দায়ীদের বিচারের ব্যবস্থা করা। একইসাথে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি আন্তর্জাতিক তদন্তও হওয়া উচিত।
৩. ডিবি হেফাজতে আটকে রাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের অবিলম্বে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মামলা প্রত্যাহার, নতুন করে মামলা না দেওয়া এবং গ্রেপ্তকৃতদের মুক্তি দেওয়া (কেননা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরাই বলছেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সহিংসতায় লিপ্ত হয়নি) এবং গায়েবি মামলা ও ব্লক রেইড দিয়ে ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার বন্ধ করা। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের নিরাপত্তা দেওয়া এবং ভবিষ্যতে হয়রানি না করার অঙ্গীকার করা।
৪. সহিংসতায় নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা এবং প্রয়োজনের নিরীখে পরিবারের কোনো সদস্যের চাকুরির ব্যবস্থা করা। আহতদের সরকারি খরচে চিকিৎসাসেবা প্রদানসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
৫. শিক্ষার ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গন-সহ জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কাউফিউ তুলে নিয়ে এবং ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে বাকস্বাধীনতা-সহ জনগণের সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।
৬. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সিট বাণিজ্য বন্ধ করে যথাযথ নিয়মে প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ করা, অছাত্রদের হলে অবস্থান নিষিদ্ধ করা এবং কমনরুম কালচার, ব্যাগিং কালচার ইত্যাদি বন্ধ করা। ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ছাত্রত্ব বাতিলের অঙ্গীকার করা। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশে সারাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা।
৭. গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধান অনুযায়ী লেজুরবৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং স্বাধীন ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা।
৮. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার বন্ধ করা এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো থেকে বিরত থাকা।
৯ গণতান্ত্রিক অধিকারসহ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।
১০. রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা কনরা এবং সংবিধানকে প্রকৃত অর্থেই অসাম্প্রদায়িক চরিত্রে ফিরিয়ে আনা।