সম্ভাবনাময় আখাউড়া স্থলবন্দরে কেবল সংকট আর ভোগান্তি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ১৯৯৪ সালে সর্বপ্রথম আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য শুরু হয়।
প্রথম নিউজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ১৯৯৪ সালে সর্বপ্রথম আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য শুরু হয়। বর্তমানে প্রতিদিন এ বন্দর দিয়ে দেড় থেকে দুই লাখ মার্কিন ডলারের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয়। এছাড়া এ বন্দর এখন স্থলপথে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। যাত্রীদের দেওয়া ভ্রমণ কর বাবদ বছরে সরকারের প্রায় ১২ কোটি টাকা রাজস্ব আসছে এই বন্দর থেকে। তবে সম্ভাবনাময় এ বন্দরে কাঙ্ক্ষিত যাত্রীসেবা না পাওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যই আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে যাত্রী পারাপার ক্রমশ বাড়ছে। বন্দর থেকে সীমান্ত পেরুলেই আগরতলা শহর। আর সেখান থেকে বিমানবন্দর ও রেলওয়ে স্টেশন খুব কাছে। ফলে পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ যাত্রী চিকিৎসা কিংবা ভ্রমণের জন্য ভারত যেতে আখাউড়া স্থলবন্দরটি ব্যবহার করেন। এজন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও যাত্রীসেবা বাড়ালে আখাউড়া স্থলবন্দরটিও সরকারের জন্য অনেক লাভজনক হবে। পাশাপাশি বেনাপোল বন্দরের ওপরও চাপ কমবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় এক হাজার যাত্রী যাতায়াত করছেন। যার অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে ভারতে যান। প্রত্যেক যাত্রীকে ভ্রমণ করতে দিতে হয় ৫০০ টাকা। এ বন্দর থেকে সরকার ভ্রমণ কর বাবদ মাসে প্রায় এক কোটি টাকা রাজস্ব পাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবে যাত্রী পারাপারের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়।
এদিকে, ভারতের আগরতলায় এক ছাদের নিচেই যাত্রীরা ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও ব্যাগ স্ক্যানিং সুবিধা পেলেও আখাউড়া স্থলবন্দরের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখানে সোনালী ব্যাংকের বুথে ভ্রমণ ট্যাক্স পরিশোধের পর জরাজীর্ণ ভবনের ছোট্ট কক্ষে সম্পন্ন হয় কাস্টমস। এরপর ব্যাগ স্ক্যানিংয়ের জন্য যাত্রীদের যেতে হয় বিজিবি চৌকিতে। সেখান থেকে আবার যেতে হয় পরিত্যক্ত ছোট্ট ইমিগ্রেশন ভবনে। বন্দরে এই অব্যবস্থাপনায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের।
তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ ইমিগ্রেশন ভবনে। জরাজীর্ণ ভবনটি আরও প্রায় এক দশক আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ভবনের কিছু অংশে পলেস্তারা খসে পড়েছে। তবুও ঝুঁকি নিয়ে এখানেই চলে দুই দেশের যাত্রীদের ইমিগ্রেশনের কাজ। এখানে যাত্রীদের বসার জন্য নেই পর্যাপ্ত জায়গা। নেই সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার। পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক পাখা না থাকায় গরমে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েই যাত্রীদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে হয়। এছাড়া শৌচাগারের জন্য বয়োজ্যেষ্ঠ, নারী ও শিশুদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বন্দরে যাত্রীদের জন্য নেই ট্রলি সুবিধাও। বর্ষা মৌসুমে একটু বৃষ্টি হলেই ইমিগ্রেশন ভবনের সামনে জমে হাঁটুপানি। তখন যাত্রীদের দুর্ভোগের যেন আর অন্ত থাকে না।
ঢাকা থেকে আসা ভারতগামী যাত্রী রাজু আহমেদ বলেন, আগরতলায় এক ছাদের নিচে সব সেবা মিলছে, কিন্তু আখাউড়ায় সেটা হচ্ছে না। এখানে এক জায়গায় কাস্টমস, আরেক জায়গা ব্যাগেজ স্ক্যানিং ও ইমিগ্রেশন। এতে করে যাত্রীদের হয়রানি হতে হয়। এছাড়া পুরো বন্দর ঘুরেও সুপেয় পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট মিলে না। প্রথম দেখায় ইমিগ্রেশন ভবনটিকে যে কারোরই মনে হবে পরিত্যক্ত কোনো কিছু। এ সংকটগুলো ভারতীয়দের চোখে আমাদের দেশকে ছোট করে।
স্বর্ণলতা নামে সিলেটের আরেক যাত্রী জানান, যাত্রী সুবিধায় বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা উচিত। যাতে করে ভারতীয়রা এসে দেখেন যে আখাউড়ায় যাত্রী সুবিধা তাদের দেশের চেয়েও অনেক ভালো। বিশেষ করে পর্যটক টানতে এটি করা খুবই জরুরি। পাশাপাশি নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার করার দাবি জানান তিনি।
জানা গেছে, যাত্রী দুর্ভোগ লাঘবে একই ছাদের নিচে সকল সেবা দিতে ২০১৬ সালে পুরাতন ইমিগ্রেশন ভবনের পাশে নতুন ছয়তলা বিশিষ্ট আধুনিক ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তবে সীমান্তের দেড়শ গজের মধ্যে স্থাপনা করা যাবে না জানিয়ে কাজে বাধা দেয় বিএসএফ। পরবর্তীতে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার পর ভবনের নকশা পরিবর্তন এবং ছয়তলার পরিবর্তে ৩৫ ফুট উচ্চতা অর্থাৎ দুইতলা ভবন নির্মাণের শর্তে পুনরায় কাজ শুরু হয়। তবে একতলার নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে আবারও বিএসএফের বাধায় বন্ধ হয়ে যায় নির্মাণকাজ।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট পুলিশের ইনচার্জ স্বপন চন্দ্র দাস বলেন, আমরা যাত্রীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছি না সেটি সত্যি। তবে আমরা সাধ্যমতো যাত্রীদের সমস্যাগুলো নিরসনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিছু সমস্যার সমাধানও করেছি। যাত্রীদের এখন যে দুর্ভোগ আছে- সেগুলো নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শেষে হলে আর থাকবে না। তিনি আরও বলেন, যাত্রীদের সন্তোষজনক সেবা দিতে আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। নতুন ভবনের নির্মাণকাজ পুনরায় শুরুর বিষয়ে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। আশা করছি শিগগিরই কাজ শুরুর বিষয়ে নির্দেশনা আসবে।