সংকটে ঘুরপাক খাচ্ছে যেসব ব্যাংক

দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা মোটেও সুখকর নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যায়নে কেবল দুর্নীতির কারণেই ১২টি ব্যাংকের অবস্থা খুব খারাপ।

সংকটে ঘুরপাক খাচ্ছে যেসব ব্যাংক
ফাইল ফটো

প্রথম নিউজ, ঢাকা: দেশের অর্থনীতি যেভাবে বড় হয়েছে, একইভাবে বড় হয়েছে দেশের ব্যাংক খাতও। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সেরা ৯০টি নাম করা ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশের একটি ব্যাংকের নামও রয়েছে। অপরদিকে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা মোটেও সুখকর নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যায়নে কেবল দুর্নীতির কারণেই ১২টি ব্যাংকের অবস্থা খুব খারাপ। এগুলোকে নীতি সহায়তায় ছাড় দিয়ে সচল রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, সরকারি- বেসরকারি এই ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ। কমে যাচ্ছে প্রকৃত আয়। এছাড়া ঝুঁকি মোকাবিলায় এই ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। সব মিলে দুর্নীতির চক্রে পড়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংক খাত। এর মধ্যে দুই বছর ধরে চলছে করোনার আঘাত। এতে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা আরও প্রকট হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত ডিসেম্বর প্রান্তিকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এসব জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বেশি খেলাপি ঋণ থাকা ২২টি ব্যাংকে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারা বলছেন, সাধারণত ৫ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি ঋণকে সহনীয় বলা হয়। ১০ শতাংশের বেশি খেলাপি হলে তা উদ্বেগজনক মনে করা হয়। যদিও খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত তদারকি করা হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ খেলাপি ঋণ ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ করে। যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি, তাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় প্রভিশন ও মূলধন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। ফলে ওইসব ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশও ঘোষণা করতে পারে না। অপরদিকে, খেলাপি ঋণ বেশি থাকলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকারি-বেসরকারি ৯টি ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না। এছাড়া ১০ ব্যাংকের মূলধনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এই ব্যাংকগুলোতে বিদায়ী বছরজুড়ে নানা ছাড় দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার দুই-ই বেড়েছে।

সংকটের শীর্ষে রয়েছে যেসব ব্যাংক: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি সংক্রান্ত উদ্বেগজনক তালিকায় আছে সরকারি খাতের ৯টি, বেসরকারি খাতের ৫টি ও বিদেশি খাতের একটি ব্যাংক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে  ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের, ৯৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সমস্যাগ্রস্ত আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৭৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। তৃতীয় দেউলিয়া পর্যায়ের পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। চতুর্থ সরকারি বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। পঞ্চম স্থানে থাকা আরেক সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৪৭ দশমিক ৬০ শতাংশ।  এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৩৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের ১৮ দশমিক ৯৮, সোনালী ব্যাংকের ১৭ দশমিক ৯৬, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১৫ দশমিক ১৫, রূপালী ব্যাংকের ১৪ দশমিক ৯০ এবং অগ্রণী ব্যাংকের ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এবি ব্যাংকের ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ১২ দশমিক ৭৫ ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। 

মূলধন ঘাটতিতে ১০ ব্যাংক: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ার কারণে গত বছরের ডিসেম্বরে ১০টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এগুলো হলো— সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন, আইসিবি ইসলামিক, বাংলাদেশ কমার্স ও ন্যাশনাল ব্যাংক। একই কারণে ৯টি ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়। এগুলো হলো— জনতা, বেসিক, অগ্রণী, রূপালী ন্যাশনাল, বাংলাদেশ কমার্স, আইএফআইসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ও স্টান্ডার্ড ব্যাংক।

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বলেছে, করোনার আগে থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দুর্বল ছিল। এখন ঝুঁকি আরও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নানাভাবে ছাড় দেওয়ার পরও গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, আমানত কমেছে, টাকা তোলার হার বেড়েছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর আয় কমেছে, প্রণোদনার ঋণ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, ঋণ আদায় তলানিতে। বাড়েনি বিনিয়োগ সক্ষমতা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন,  আগের চেয়ে করোনার দুই বছরে ব্যাংক খাতে সুশাসন ব্যবস্থার অবনতি হয়েছে। গত দুই বছরে ঋণ আদায়ে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তার খেসারত দিতে হবে ব্যাংকগুলোকে।

ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হার বেড়েছে: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনার কারণে ঋণ আদায় স্থগিত থাকায় ও খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হার বেড়েছে। দুই বছর আগে এ সম্পদ ৯ শতাংশের নিচে ছিল। এখন তা বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

সুদ আয় নেতিবাচক: ব্যাংকগুলো ঋণ থেকে আগে যেভাবে আয় করতো, গত বছর সেই তুলনায় আয় কমেছে। করোনার সময় সুদ আদায় স্থগিত থাকায় এ খাতে আয় কমেছে। অবশ্য  বেড়েছে সার্ভিস চার্জ ও কমিশন থেকে। সরকারি বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ঋণ থেকে সুদ আয় এখনও নেতিবাচক। তবে গত বছরের তুলনায় এ হার কিছুটা বেড়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এই আয়ও কমেছে। যদিও গত ডিসেম্বরের তুলনায় বেড়েছে। সাধারণত, ব্যাংকগুলোর আয়ের প্রধান অংশই আসতো সুদ থেকে। কিন্তু এ খাতের আয় কমে গেছে।

যে কারণে মুনাফা দেখিয়েছে ব্যাংক: বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সুযোগ ছিল—  কোনও ঋণ বা সুদ পুরো আদায় না হলেও ২৫ শতাংশ ঋণ পরিশোধ করলে, ওই সুদ আয় খাতে নিতে পারবে। এছাড়া নিয়মিত ঋণের সুদও আয় খাতে নিতে কোনও বাধা নেই। করোনাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনার আলোকে ব্যাংকগুলো সুদ আদায় করেই তা কাগজে-কলমে আয় খাতে নিয়ে মুনাফা দেখিয়েছে। তাতেও এ খাতে আয় আগের চেয়ে কম। এটি ব্যাংক খাতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ । তিনি বলেন, ‘কাগুজে আয় সাময়িক স্বস্তি দিলেও ব্যাংকের জন্য এই নীতি ভালো না। দীর্ঘ মেয়াদে এটি বিপদ ডেকে আনবে। কাগুজে মুনাফার প্রবণতা থেকে বের হওয়াটা জরুরি।’

হঠাৎ আমানত কমে গেছে: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জুনের পর থেকে হঠাৎ করে ব্যাংকের আমানত কমতে শুরু করেছে। এতে বড় ব্যাংকগুলোর জন্য সমস্যা না হলেও ছোটগুলো পড়েছে বিপাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুলাই-জানুয়ারি সময়ে আমানত কমেছে ৫২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়েছিল ৪৪ শতাংশ।

কী করছে বাংলাদেশ ব্যাংক: ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র জানতে গত জানুয়ারি থেকে সফটওয়্যারের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোতে পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে নানা অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। ব্যাংকের আয় কমে যাচ্ছে। আরও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এছাড়া ঋণ বিতরণে অনিয়মের চিত্রও উঠে আসছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক যথা সম্ভব  চেষ্টা করে যাচ্ছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাংকগুলোকে বাস্তবতার নিরিখে করোনাকালে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, অর্থনীতির স্বার্থে এটি করা হয়েছে। এখন সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতও স্বাভাবিক হয়ে আসছে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom