লাগামহীন ডেঙ্গু পরিস্থিতি, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস

চলতি বছরের ২ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা গত ২১ বছরের মধ্যে দেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু।

লাগামহীন ডেঙ্গু পরিস্থিতি, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস

প্রথম নিউজ, ঢাকা: সারাদেশে লাগামহীন ডেঙ্গু পরিস্থিতি। আক্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। দেশের ইতিহাসে এত বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি আর কখনো। চলতি বছরের ২ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা গত ২১ বছরের মধ্যে দেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। ধারণা করা হয়েছিল, আগস্টের পর ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে আসবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশে দিন দিন ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে, যা আগামী নভেম্বরে আরও ভয়ানক রূপ নিতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগের মৌসুম ধরা হয় মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডেঙ্গু বছরব্যাপী হচ্ছে। এরমধ্যে আক্রান্তের গ্রাফ সবচেয়ে ওপরের দিকে থাকে জুলাই ও আগস্ট মাসে। গত বছর দেশে ডেঙ্গুর পিক সিজন ছিল অক্টোবর ও নভেম্বরে। কাজেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। দেশে ডেঙ্গুর লার্ভার উপস্থিতির যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা উদ্বেগজনক।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মশা নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা এবং রোগী ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণে রোগটি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। এ বছর এডিস শনাক্তে চালানো জরিপে ঢাকায় মশার যে উপস্থিতি দেখা গেছে, সেটি ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ। এবার ঢাকার বাইরে আশঙ্কাজনক হারে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। বস্তুত ঢাকার বাইরের রোগী বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোয় চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৫১ হাজার ২৭২ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এক বছরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর এ সংখ্যা এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯ সালে দেশে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এবার বছরের চার মাস বাকি থাকতেই সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল।

এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। জুন মাসে যেখানে পাঁচ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, জুলাই মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ৮৫৪ জনে। আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সেপ্টেম্বরের ১১ দিনেই ২৭ হাজার ৪৬৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মাসের হিসাবে জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে এক হাজার ৩৬ জন ও জুন ৫ হাজার ৯৫৬ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গুর প্রকোপের বিস্তারের মধ্যে শুধু রোগী ভর্তি নয়, মৃত্যুর সংখ্যাও এ বছর বেড়েছে। জুন থেকে এ রোগে মারা যাওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে; ওই মাসে মৃত্যু হয় ৩৪ জনের। জুলাইয়ে তা অনেক বেড়ে ২০৪ জনে গিয়ে ঠেকে। আগস্টে সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে ৩৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সেপ্টেম্বরের ১১ দিনে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৮ জনে।

চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন এবং শক সিনড্রোমে মারা গেছেন। এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এর আগে ২০১৯ সালে দেশের ৬৪ জেলায় রেকর্ড এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সরকারি হিসাবে সে বছর মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি সব বারের চেয়ে আলাদা। যেটা অনুমান করা যাচ্ছে, আগামী দিনে আরও ভয়ংকর রূপে ডেঙ্গু আসবে। যতদিন যাবে ততদিন খারাপভাবে রোগী হাসপাতালে আসবে। চিকিৎসকরা চেষ্টা করার পরও রোগীকে বাঁচাতে পারবে না। তাই সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিতে হবে।

বেশি মৃত্যুর কারণ : বেশি মৃত্যুর কারণ কী? উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, তিনটি কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুহার বেশি হতে পারে বা বেশি মনে হতে পারে। বাংলাদেশে যারা হাসপাতালে ভর্তি হন এবং তাদের মধ্যে কতজন মারা যাচ্ছেন সেই হিসাব দেওয়া হয়; কিন্তু প্রকৃত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করলে হারটা হয়তো কম হতো। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে একই সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাসের দুটি ধরন সক্রিয় আছে। এরজন্য রোগীর জটিলতা বেশি দেখা দিচ্ছে। তৃতীয়ত, হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকতে পারে। রোগীর শরীরে তরল ব্যবস্থাপনা (ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট) এবং অণুচক্রিকা ব্যবস্থাপনা ঠিক হচ্ছে কি না, তার সঠিক চিত্র জানা নেই।

তবে ৩১ আগস্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাপ্তাহিক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছেন। ৮১ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে। এর অর্থ, যারা মারা যাচ্ছেন, তারা দেরি করে হাসপাতালে আসছেন। যখন হাসপাতালে আসছেন তখন চিকিৎসকদের বিশেষ কিছু করার থাকছে না।

ওই পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, মৃত রোগীর ৬৪ শতাংশের মধ্যে ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম দেখা গেছে। ২৪ শতাংশ রোগীর লক্ষণ ছিল এক্সপানডেড ডেঙ্গু। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ছিল ৮ শতাংশ রোগীর। আর মৃত ব্যক্তির ৪ শতাংশের অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের সঙ্গে ডেঙ্গুও ছিল।

চিকিৎসা সেবায় হিমশিম : ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে শয্যা পেতে ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন অনেক রোগীর স্বজন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গিয়ে দেখা মেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু আয়মানের সঙ্গে। হাসপাতালে ভর্তির জন্য সন্তানকে নিয়ে অপেক্ষায় তার বাবা-মা। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় এর আগে শিশুটিকে বনশ্রীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। আয়মানের বাবা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, প্রথমে আমরা গ্রিন রোডের একটি হাসপাতালে গেলেও তারা ভর্তি না করায় বাসার পাশে বনশ্রীর একটি ক্লিনিকে নিয়ে ওকে ভর্তি করি। পরে সেখান থেকে এখানে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত এক চিকিৎসক বলেন, আমরা আসলে সব রোগীকেই ভর্তি করতে পারি না। বেশির ভাগ রোগী জ্বরে আক্রান্ত হলেই হাসপাতালে ছুটে আসছে। তবে আমাদের সব আসন এখন পূর্ণ থাকায় নতুন করে ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। বেশি জরুরি হলে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে এখন পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন মোট ৯ হাজার ৭৯৪ জন। ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯ হাজার ৩৭২ জন, মৃত্যু হয়েছে ১১৩ ডেঙ্গু রোগীর। নতুন করে ভর্তি হওয়া ৮৫ জনসহ বর্তমানে ৩০৯ রোগী হাসপাতালটির ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, ডেঙ্গু ওয়ার্ডে পা ফেলার জায়গা নেই। ফাঁকা নেই রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা। অনেকে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বেশির ভাগ রোগীই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এক লাফে রোগী ভর্তির সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়ালেও বাড়েনি চিকিৎসক, নার্সিং স্টাফ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা। ফলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও পরিস্থিতি সামাল দিতে কার্যত হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস : ঢাকার ফায়েদাবাদ চুয়ারিটেক এলাকায় একটি একান্নবর্তী পরিবারের ২৭ জন সদস্যের মধ্যে ১৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। পরিবারের অসুস্থ সদস্যদের চিকিৎসা বাবদ দুই মাসে ব্যয় হয়েছে ৮ লাখ টাকার বেশি। শুধু হাসপাতালের বিলই দিতে হয়েছে সাত লাখ টাকার মতো। এই ব্যয় সংকুলান করতে গিয়েও হিমশিম খেতে হয়েছে এই পরিবারকে। দীর্ঘ দুই মাস ডেঙ্গুর সঙ্গে যুদ্ধে রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটেছে পরিবারের অন্য সদস্যদের। আক্রান্তদের কারও কারও জটিলতা রীতিমতো ভয় পাইয়ে দিয়েছিল অন্যদের।

চাহিদার তুলনায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা কম থাকায় ৯০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে। সাধারণত বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রতি ২৪ ঘণ্টায় আইসিইউর ভাড়া, কেবিন ভাড়া, ওষুধপত্র, থাকা-খাওয়াসহ প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ পরে। এই ব্যয় মেটাতে গিয়ে রোগীর স্বজনদের নাভিশ্বাস উঠেছে। খরচ কুলাতে না পেরে অনেকে জমিজমা বিক্রি করে ব্যয় মেটাচ্ছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করে ডেঙ্গু ডেথ রিভিউ কমিটি জানিয়েছে, আগামীতে আরও ভয়াবহ হবে পরিস্থিতি, কঠিন হবে রোগী বাঁচানো। তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাছের হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।